পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা বা সীমা নেই। এক জন পুরুষ চাইলেই একাধিক বিয়ে করতে পারেন, একই সঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারেন। কিন্তু নারী কোনও ভাবেই স্বামীর জীবদ্দশায় আর একটি বিয়ে করতে পারেন না। নারী কেবল সীমিত ক্ষেত্রে জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকারী হতে পারেন। হাজার নিগ্রহ সত্ত্বেও স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ পাবেন না। ফলে তিনি আর কোনও বিয়েও করতে পারবেন না, কারণ বিবাহবিচ্ছেদের কোনও আইনি অস্তিত্বই দেশে নেই।
বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইন এমনই। ভারতে যেমন মুসলমান সমাজের তিন তালাক, বহুবিবাহ বা দত্তক প্রথার সংস্কার চেয়ে আইন তৈরির দাবি সমাজের ভিতরকার নানা রকমের পাল্টা দাবি, কুযুক্তি এবং রাজনৈতিক জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, বাংলাদেশেও মান্ধাতা আমলের হিন্দু আইন সংস্কারের চেষ্টা এবং উদ্যোগ একই কারণে আটকে রয়েছে। পারিবারিক আইন সংস্কারের যে কোনও উদ্যোগের বিরোধিতায় দুই দেশে সংখ্যালঘুদের একাংশ একই সুরে সরব।
১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইনের কোনও সংস্কার হয়নি। দেশভাগের পরে ভারতে ১৯৫৫ সালে প্রাচীন হিন্দু আইনে ব্যাপক সংস্কার করে নতুন বিবাহ আইন তৈরি হয়, বহুপত্নীর বিধান বিলুপ্ত হয়। বিবাহবিচ্ছেদ পদ্ধতির প্রবর্তন হয়। প্রাচীন দায়ভাগ এবং মিতাক্ষরা নির্ধারিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অংশ স্বীকৃত হয়। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তানে পুরনো সেই হিন্দু আইন বলবৎ থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রাচীন দায়ভাগ প্রথা কার্যকর রয়েছে। অথচ ১৯৬১ সালেই শরিয়ত আইন সংস্কার করে সে দেশে তালাক, নিকা হালালা এবং বহু বিবাহের ক্ষেত্রে মুসলমান নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর ফলে বাংলাদেশে হিন্দু নারীর মানবাধিকার লাঞ্ছিত। হিন্দু পরিবারে পুত্রসন্তান থাকলে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার নেই। পুত্র না থাকলে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে মেয়ে প্রয়াত পিতার সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার পেলেও তা কেবল জীবনস্বত্বে সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার, যথার্থ মালিকানা (বিক্রি, দান কিংবা হস্তান্তরের অধিকার) নয়। ওই কন্যার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্পত্তি তাঁর প্রয়াত পিতার নিকটতম পুরুষ উত্তরাধিকারীর (পৌত্র, প্রপৌত্র, ভাই, ভাইপো ইত্যাদি) মালিকানায় চলে যায়। এমনকী মায়ের নিজস্ব সঞ্চিত অর্থ বা সম্পদেও মেয়ের উত্তরাধিকার স্বীকৃত নয়।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী বিয়ে কোনও চুক্তি নয়, অলঙ্ঘনীয় ধর্মীয় বিধান। ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রীর জন্মজন্মান্তরের পবিত্র এবং অটুট বন্ধন। তাই বিচ্ছেদের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ১৮৫৬ সালের হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন বাংলাদেশে বলবৎ হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে তার প্রয়োগ বিশেষ নেই। ভারতেও অবশ্য বর্ণহিন্দুরা বিধবা বিবাহ নিয়ে এখনও মোটেই সহজ নয়। বাংলাদেশে হিন্দু আইনে বিবাহবিচ্ছেদের বিধান না থাকলেও ‘হিন্দু ম্যারেড উইমেনস রাইট টু সেপারেট রেসিডেন্স অ্যান্ড মেনটেন্যান্স অ্যাক্ট ১৯৪৬’ অনুযায়ী সীমিত ক্ষেত্রে স্ত্রীরা আলাদা বাস করার অধিকার এবং ভরণপোষণ পেয়ে থাকেন। তবে তার জন্য নির্দিষ্ট আদালতে দাম্পত্য অধিকার আদায়ের জন্য মামলা করতে হয়। বাংলাদেশে হিন্দু আইনে দত্তক অনুমোদিত। কিন্তু কেবল ছেলেদেরই দত্তক নেওয়া যায়। কন্যাদত্তক আইনসিদ্ধ নয়। কেন না শাস্ত্র মতে পুত্রসন্তানই বংশের ধারা বজায় রাখে এবং পিণ্ড দান করতে পারে। কেবল পিণ্ডদানের অধিকারীই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে। বাংলাদেশে কোনও মহিলা দত্তক নেওয়ার অধিকারী নন। হিন্দু আইন অসবর্ণ বিয়েও অনুমোদন করে না।
বাংলাদেশে হিন্দু আইনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনও হয় না। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে ২০১২ সালে বিবাহ নিবন্ধন আইন পাশ করা হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দেখা গেল বাধ্যতামূলক না করে রেজিস্ট্রেশন ঐচ্ছিক করা হয়েছে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা না থাকায় হিন্দু পুরুষ তার স্ত্রীকে ছেড়ে চলে গেলে স্ত্রী কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। ভরণপোষণ কিংবা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তাও চাইতে পারেন না।
২০১২ সালে বাংলাদেশ আইন কমিশন হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। তাতে এই সংস্কারের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। ১৯৫৫ সালের ভারতীয় হিন্দু বিবাহ আইনের ধারাগুলো অনুসরণ করে ‘নাগরিক উদ্যোগ’ নামে বাংলাদেশের জাতীয় ও জেলা পর্যায়ের পঞ্চাশটি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের এক মোর্চা ২০১২ সালে হিন্দু আইনের একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পেশ করে। আজও তার কোনও গতি হয়নি। ভারতে মুসলিম নারী সংগঠনগুলো মুসলিম পারিবারিক আইনের যে খসড়া পাঁচ বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করেছিল সেটিও লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রয়েছে। অদ্ভুত মিল। অথচ আইন কমিশনের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ মনে করে হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার থাকা উচিত।
বাংলাদেশে সংখ্যায় কম হলেও প্রভাবশালী যে হিন্দুরা ধর্মীয় আইন সংস্কারের বিরোধিতা করছেন তাঁদের বক্তব্য, ‘স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সবকটি সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে দুর্বল করে রাখার অলিখিত নিয়ম অনুসরণ করেছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা না দেওয়া পর্যন্ত পারিবারিক আইন সংশোধন সম্ভব নয়।’ তাঁদের যুক্তি, হিন্দু আইন তাঁদের ধর্মের অঙ্গ। এই আইনের সংস্কারকে তাঁরা ‘হিন্দু পারিবারিক ঐতিহ্যের উপর আঘাত’ বলে মনে করেন। যুক্তিগুলো খুবই চেনা মনে হচ্ছে না?
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড় সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ অবশ্য হিন্দু আইন সংস্কারের পক্ষে। তবে তাঁরা মনে করেন, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছেই, তারা অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে রয়েছে। অস্তিত্ব রক্ষা করবে না কি তারা অভ্যন্তরীণ সংস্কার করবে! তাই সংস্কারের কাজ এগোচ্ছে না। পারিবারিক আইন সংস্কারের প্রশ্নে প্রায় একই বক্তব্য ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের একটি অংশের। আবার, দুই দেশেই, এই অংশটিই সংখ্যালঘু সমাজের মুখ। এ কি সংখ্যালঘুর চরিত্রলক্ষণ, না মৌলবাদের উদ্ধত উচ্চারণ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy