রোহিঙ্গাদের ব্যাপারটা মিইয়ে এসেছে। তার মানে এই নয়, তাঁরা এখন এতটুকু কম কষ্টে আছেন বা রোহিঙ্গা শিশুর মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে রোহিঙ্গা বাবার বুক কিছু কম ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু ভাই, অন্যের যে কোনও বেদনাই দিন পনেরো পরে বোরিং হয়ে যায়। এমনকী প্রিয়জনের ক্যানসার ধরা পড়ার প্রথম দু’হপ্তা তাকে সঙ্গ দেওয়ার ধুম পড়ে গেলেও, জিনিসটা যখন তিন বছর টানে, শেষ দিকে ক্রমাগত অফিসের কাজ পড়ে যেতে থাকে। যারা আগুনে-প্রবন্ধ লিখে বিখ্যাত, তারাও যদি একই বিষয়ে পর পর লেখা জমা দেয়, সম্পাদক তুরন্ত ছাপা বন্ধ করে দেবেন। সমাজসচেতনতারও বৈচিত্র দরকার। এই মাসে হয়তো রোহিঙ্গা নিয়ে লিখলে, তার পর জি ডি বিড়লা সামনে এসে গেল, সেটা পুরনো হতে না হতে তোমায় নার্সিং হোমের অমানবিকতার সুতোটা ধরে ফেলতে হবে। কিছু লোক ‘চাকুরে-বিপ্লবী’, সারা জীবন একই সমস্যার আন্ডারে মুষ্টি তড়পায়, তারা মাঝে মাঝে সেমিনার বা প্রাইজ বাগালেও, লোকে তাদের দেখলেই পালায়। ওই রে, নদীনালার ভাষণ শুরু হবে! খেয়েছে, সোমালিয়া পার্টি এসে গেছে! তার চেয়ে, ফেসবুক-বিপ্লবীদের মতো, ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে উত্তেজিত হয়ে হাইপার-গালাগাল দেওয়ার দায় ঘাড়ে নিলে, সিরিয়াস লেখকদেরও মার্কেট জমানোর চান্স বেশি।
বছর দুই আগে যে বারো বছরের ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে ফুটপাত থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে দু’জন অ্যাপ-ক্যাবের ড্রাইভার বার বার ধর্ষণ করল, তার পর গলা মুচড়ে খুন করে ছুড়ে ফেলে দিল, সে-মেয়ের দরদে তখন মোমবাতি মিছিল হয়েছিল, কিন্তু এখন তার কথা কারও মনে নেই। থাকা সম্ভবও নয়। পাঁইপাঁই ঘটনা ঘটছে, নতুন অন্যায়ের নীচে নাগাড়ে পুরনো অপরাধ চাপা পড়ছে। তা ছাড়া যে খবর নিয়ে এখন সবাই মত্ত তার কামরায় চড়ে পড়লে মনোযোগ এবং সমষ্টি-ওম বেশি পাওয়া যাবে, নতুন অ্যাঙ্গল দিতে পারলে তো কথাই নেই। তার চেয়ে বড় কথা, যদি সত্যিই সব ক’টা অন্যায় আঙুলের করে নখ গিঁথে মনে রাখতে হয়, তা হলে তো লোকে মন পাগলিয়ে পাঁচমাথায় উদ্দাম দৌড়বে। সত্যি যদি কেউ রোহিঙ্গাদের, এক জন রোহিঙ্গারও, অসহ্য কষ্ট প্রকৃত অনুধাবন করার চেষ্টা করেন, যে রাতারাতি তার ঘরবাড়িজীবন হারিয়ে হাতজোড় করে আশ্রয় চাইছে আর যাকে সব দেশ ‘দূর দূর’ করে তাড়াচ্ছে বা রোহিঙ্গা কেন, যদি কোনও আশ্চর্য অনুশীলনে কেউ পৃথিবী জোড়া লাখ লাখ রিফিউজির এক জনের বেদনাও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, যে নৌকায় ভাসছে আর নিজের হিসি খেয়ে তেষ্টা মেটাচ্ছে, এমনকী রিলিফ ক্যাম্পে পৌঁছলেও সেখানে তার বরাদ্দ খাবার প্রহরীরা চড়া দামে অন্যকে বিক্রি করছে এবং সে অসুস্থ হলে তাকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে যাতে সেবা করার দায়িত্ব ঘাড়ে না চাপে— তা হলে তো দরদি মানুষটি গলায় দেওয়ার দড়ি খুঁজবেন। মায়ানমারে রোহিঙ্গা বাচ্চা খুন করা হয়েছে প্রায় সাড়ে সাতশো। আড়াই বছরের একটা বাচ্চা টলমলিয়ে একগাল হেসে হাঁটছে আর মিলিটারি তার কপালে একটি বুলেট সেঁধিয়ে কালো গর্ত করে দিল, এ দৃশ্য কল্পনা করলেও হাত-পা কাঁপে। অত দূরেই বা যেতে হবে কেন, যে ভিখিরি চট জড়িয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় শুয়ে মরছে, তার গরম-শিক জ্বালাটা আমরা অনুভব করার চেষ্টা করি কি? যদি করতাম, তা হলে হয়তো ওই একটা বিষয় নিয়ে লড়ে যাওয়ার জন্য এক জীবনও যথেষ্ট মনে হত না! এ বার, গোঁয়ার লোকে প্রশ্ন করতে পারে, যাদের দুঃখ মর্মে আঁচড়ায় না, তাদের নিয়ে লিখলে বা বক্তৃতা করলে তা এক রকম ভণ্ডামি হচ্ছে না? বা কেউ বলতে পারে, বারো বছরের সেই ধর্ষিতা মেয়েটিকে যদি ওই মোমবাতি মিছিলেই ফেলে এলে, তাকে সারা জীবন পাঁজাকোলা করে না-ই রাখলে, তা হলে তোমার আত্মা ফাঁকিবাজ।
কথাগুলো শুনতে বেশ তীব্র, কিন্তু আসলে হাবিজাবি। প্রথমত বিস্মরণই মানুষের সেরা রক্ষাকবচ, এমনকী সঞ্জীবনী। মা মরে যাওয়ার যন্ত্রণাও ভুলতে শিখতে হয় এবং পিকনিকে যেতে হয়, তা-ই জীবনধর্ম। দ্বিতীয়ত, সকালে সবহারার দুঃখে উদ্বেল হব আবার বিকেলে চিলি চিকেনও পূর্ণ ভোগ করব— এই সবটা পারে বলেই মানুষ এমন অদ্ভুত চমৎকার। জীবন অনেকটা ও অনেক রকম, শুধু অবিচারের আইটেমের তলায় চেপটে নুয়ে গেলে, তা হবে একবগ্গা যাপন। তৃতীয়ত, ‘অনুভব করেছি, তাই বলছি’: এটাই প্রতিবাদী লেখার একমাত্র শর্ত কে বললে? অন্যায়টাকে যুক্তি দিয়ে খচাৎ বিঁধে ফেলাই তো অনেক।
তবে, এত ভারিক্কি তক্ক উদ্ভূত হওয়ারও কারণ নেই। আমরা সব্বাই নিশ্চয়ই এতটা বোকা নই যে ভাবব, লেখালিখি করে (বা সেই লেখা শেয়ার করে) এই অন্যায়গুলোর একটারও এতটুকু নিষ্পত্তি সম্ভব। আমরা প্রতিবাদ করি, যাতে আমাদের অহং তৃপ্ত হয়। অন্তত নিজের কাছে দাখিল করতে পারি, ‘ঠিক-এর দলে ছিলাম।’ আর লিখে যদি নাম হয়ে যায়, ক্যান্টার! বইমেলায় সই দাও। তার বদলে, বড়লোকের মাতাল ছেলের গাড়ি-চাপা পড়া জওয়ানের জন্য কেঁদে ময়দানে আড়াই বছর ঠায় বসে থাকলে, অন্য জওয়ানরাই গুঁতিয়ে তুলে দেবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy