প্রতীকী ছবি।
আমাদের গণতন্ত্রে এক অদ্ভুত বিরোধাভাস রয়েছে। তাত্ত্বিক রাজনীতির পরিসরে আমরা খুব উদার, খুব গণতান্ত্রিক, খুব প্রগতিশীল। কিন্তু রাজনীতির ফলিত পরিসরে আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের অনেক কিছুই যেন অস্তিত্বহীন, গুরুত্বহীন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের। সংবিধানই সে স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু অধিকারটা সংবিধানের পাতাতেই রয়ে গিয়েছে বলে আজ প্রতীত হয়। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ আর সে অধিকারের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ হতে দিতে চায় না। কেরলের চলচ্চিত্র উত্সব তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।
তথ্যচিত্র ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির উত্সব। কেরলে উত্সবের আয়োজন। কিন্তু কোন কোন বিষয় নিয়ে সেখানে সিনেমা দেখানো যেতে পারে, কোন কোন বিষয়বস্তু স্পর্শ করা যাবে না, তা এখন কেন্দ্রীয় সরকার রক্ষণশীলতার ঘনসন্নিবদ্ধ ছাঁকনির মাধ্যমে স্থির করছে। হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা, দিল্লির জেএনইউ-তে ছাত্র বিক্ষোভ, জম্মু-কাশ্মীরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি— এই যদি হয় তথ্যচিত্রের বা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির বিষয়বস্তু, তা হলে ঘোর বিপদ। ছবি দেখানোর অনুমতি মিলবে না। ফতোয়া যদি জারি হত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তরফ থেকে, আশ্চর্য হওয়ার উপাদান থাকত না। কিন্তু আশ্চর্যই হতে হচ্ছে। কারণ এমন অগণতান্ত্রিক ফরমানের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছে দেশের সরকার, দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক।
গণতন্ত্রের এই পরিহাস গ্রহণযোগ্য যে হবে না, সে বলাই বাহুল্য। প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। সম্মিলিত বিরোধী পক্ষ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের এই অবস্থানের সমালোচনায় মুখর। তীব্র নিন্দা হচ্ছে। কিন্তু দেশের শাসক অবিচল— সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর হতে পারে, শাসকের জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ধাক্কা দিতে পারে, এমন কোনও বিষয়ের চর্চা স্বাধীন ভাবে হতে দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্রের ধারণা যে ধূলিসাত্ হচ্ছে, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার যে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বুনিয়াদি স্বাধীনতাকেই যে ধ্বংস করা হচ্ছে, শাসক সে কথা শুনতে নারাজ, বুঝতে নারাজ। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তা হলে আজ কী বলছে? নাগরিকের স্বাধীনতা ক্রমশ ছেঁটে ফেলা হচ্ছে ভারতে— এ সত্যই ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে না কি?
মানুষের স্বাধীনতা, নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীন পরিসর— এসব কি দেশে এই প্রথম বার আক্রান্ত হচ্ছে? না, আগেও আক্রান্ত হয়েছে। ইন্দিরা গাঁধী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তখন নাগরিক অধিকার ধূলিসাত্ হয়েছিল বলে বিস্তর অভিযোগ নানা মহলের। কিন্তু বৈপরীত্য আজ সেখানেও। জরুরি অবস্থায় নাগরিক অধিকারের ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন হয়েছিল বলে যে নরেন্দ্র মোদীরা বার বার অভিযোগ করেন, যে নরেন্দ্র মোদীরা ইন্দিরা গাঁধীকে বিপজ্জনক এবং স্বৈরাচারী বলে এখনও বার বার আক্রমণ করেন, সেই নরেন্দ্র মোদীদের দল এবং সরকারই নিঃশব্দে নাগরিক অধিকার হরণ করতে সচেষ্ট। কোনও বিরোধী স্বরকে তাঁরা স্বীকৃতি দিতে চান না। কোনও ভিন্ন চিন্তধারাকে অনুমোদন করেন না। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার যে পথে ভাবনা-চিন্তা করে, সেই পথের বাইরেও যে কোনও চিন্তা-ভাবনার স্রোত থাকতে পারে, ভারতের বর্তমান শাসকরা তা মানেনই না। একে স্বৈরতন্ত্র ছাড়া অন্য কী নামে ডাকা সম্ভব? ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা যদি নিন্দিত হয়, তাহলে এই জমানা প্রশংসিত হবে কোন যুক্তিতে? দুই জমানার ফারাক শুধু ঘোষণায়। ইন্দিরার জরুরি অবস্থা গণতন্ত্রের ঘোষিত অপহরণ ছিল। আর আজ কিছু ঘোষণা না করেই শাসক একটু একটু করে গিলে ফেলছে নাগরিককে সংবিধানের দেওয়া রক্ষাকবচগুলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy