বিধানসভা, না আঁস্তাকুড়? উত্তরপ্রদেশের বিধানসভায় বোমা খুঁজিতে গিয়া পুলিশ পাইয়াছে অজস্র গুটখা ও পান মশলার মোড়ক। আসনের গদির তলায় সেগুলি গুঁজিয়া রাখা ছিল। মেঝেতে সর্বত্র পিকের দাগ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশেই স্বচ্ছ ভারত অভিযানের সূচনা করিয়াছিলেন। রাজ্য বিধানসভার প্রায় আশি শতাংশ আসন ভারতীয় জনতা পার্টির দখলে। অতএব আবর্জনার দায় বিজেপি এড়াইতে পারে না। এই উত্তরপ্রদেশ হইতেই সংসদের নির্বাচনে জিতিয়াছেন মোদী। সে রাজ্যে তাঁহার দলের বিধায়করাই যদি স্বচ্ছ ভারত গড়িবার আহ্বানকে তাচ্ছিল্য করেন, তাহা হইলে সাধারণ নাগরিকের নিকট পরিচ্ছন্নতার আবেদন করিবার নৈতিক অধিকার কি প্রধানমন্ত্রীর রহিয়াছে? কেবল তাহাই নহে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশের প্রতি বিধায়করা কতটা শ্রদ্ধাবান, সেই প্রশ্নও উঠিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী হইবার তিন দিনের মধ্যে তিনি নির্দেশ দিয়াছিলেন, সরকারি দফতরে গুটখা বা পান মশলা লইয়া প্রবেশ নিষিদ্ধ, নির্দেশ অমান্য করিলে জরিমানা হইবে। তাহাতে সরকারি দফতর কতটা পরিষ্কার হইয়াছে জানা নাই। কিন্তু বিধায়কদের উপর তাহার প্রভাব পড়ে নাই, তাহা স্পষ্ট। যাঁহারা আইন প্রণয়ন করিবেন, তাঁহাদেরই যদি পুলিশ দিয়া আইন মানাইতে হয়, তবে গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়।
গণতন্ত্রের বিপন্নতা কেবল দলীয় শৃঙ্খলার অভাবের কারণে নহে। বিধানসভার কক্ষ দূষিত করিবার কাজটি এক দীর্ঘ অভ্যাসের ফল। অপরের প্রতি অশ্রদ্ধাই এই অভ্যাসকে সিঞ্চন করিয়াছে। জনস্থান কলুষিত করিলে তাহা অপরের অস্বস্তি, অসুস্থতা এমনকী মৃত্যুর কারণও হইতে পারে, সেই কথা জানিয়াও নিজেকে সংযত করিবার প্রয়োজন বোধ করেন না অধিকাংশ মানুষ। যাঁহারা নিজেদের বাড়ি দুই বেলা পরিষ্কার করাইয়া থাকেন, তাঁহারাও পথঘাট, সরকারি দফতর, জনপরিবহণ নোংরা করিতে দ্বিধা করেন না। তাঁহারা মনে করেন, পরিষ্কার করিবার কাজটি নিম্নবর্গের, দরিদ্রের, মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। পরিচ্ছন্নতার দায় তাঁহাদের নহে। সমাজ বৈষম্যে কলুষিত, তাই যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ। ‘স্বচ্ছ ভারত’ শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্প হইয়া রহিল, কারণ দরিদ্র গৃহস্থকে পরিচ্ছন্নতার পাঠদান সহজ। উচ্চবর্ণ, শিক্ষিত, ধনীকে ধমক দিবার, লজ্জা দিবার সাহস কাহারও নাই।
গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম লক্ষণ অপরের প্রতি দায়বোধ। অন্যের জীবনযাপন, সুখ-সুবিধাকে নিজের সমান গুরুত্ব দিতে পারিবার ইচ্ছা ও ক্ষমতার উপরেই গণতন্ত্র দাঁড়াইয়া আছে। আধুনিক রাষ্ট্রে এই ‘অন্য’ কে, তাহার পিতৃ-মাতৃ-পরিচয় কী, ভাষা কিংবা ধর্ম কী, সম্পন্ন না দরিদ্র, তাহা বিচারের বিষয় নহে। তিনি যে সহ-নাগরিক, ইহাই একমাত্র বিবেচ্য। একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করিবে— এমন আস্থাই গণতন্ত্রের ভিত্তি। ধর্ম-বর্ণ বিভাজিত, অসহিষ্ণু রাজনীতি হইতে সকলের প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ আসা অসম্ভব। মোদী স্বচ্ছতার আহ্বান করিয়াও সহ-নাগরিকত্বের শর্তটি ভুলিয়াছেন। নিজে সম্মার্জনী হস্তে রাস্তায় নামিয়াছেন, কিন্তু তাহা প্রতীকী। উত্তরপ্রদেশের বিধায়কদের দিয়া যদি বিধানসভা কক্ষ সাফ করাইতে পারেন, তাহাতে স্বচ্ছতার যথার্থ বার্তাটি প্রচার হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy