স্ব-নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ই যদি হয়, তবে তাহার বৈঠক বিকাশ ভবনে কেন? পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলগুলি স্বাভাবিক কারণেই এই প্রশ্নটি করে নাই। কারণ, সরকারি নিয়ন্ত্রণও চরিত্রে গোলাপের ন্যায়— তাহাকে কোন নামে ডাকা হইতেছে, সেই প্রশ্নটি অবান্তর। বেসরকারি স্কুলগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দুইটি ধাপে সন্ধান করা বিধেয়। এক, স্কুলগুলিতে স্বচ্ছতার অভাব আছে কি না? দুই, সেই অভাব ঘুচাইবার জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রণ ভিন্ন আর কোনও উপায় আছে কি না? প্রথম প্রশ্নটির উত্তর, হ্যাঁ। দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরও তাহাই। বেসরকারি স্কুলে স্বচ্ছতার অভাব পাহাড়প্রমাণ। স্কুলের পরিকাঠামোর সহিত বেতনের সমতা আছে কি না, স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত যথাযথ কি না, স্কুল জানাইতে না চাহিলে এই তথ্যগুলি জানিবার উপায় নাই। স্কুলে ভর্তি হইতে ঘুরপথে টাকা দিতে হয় কি না, এই তথ্যটি, অতএব, জানা অসম্ভব। তথ্যের এই অসমতা দূর করার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। স্কুলগুলি স্বপ্রবৃত্ত হইয়া অভিভাবকদের এই তথ্যগুলি না জানাইলে সরকার তাহাদের বাধ্য করিতে পারে। সেই এক্তিয়ার সরকারের আছে, এবং তাহা জরুরিও বটে।
কিন্তু, রাষ্ট্রের ধর্মই হইল থামিতে না জানা। কত দূর অবধি তাঁহাদের এক্তিয়ার, এবং কোন কাজটি নিতান্ত অনধিকারচর্চা, শাসকরা হামেশাই সেই সীমারেখাটি বিস্মৃত হন। গত ছয় বৎসরের অভিজ্ঞতা বলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গের শাসকরাও এই দোষে দুষ্ট। ফলে, বেসরকারি স্কুল হইতে অস্বচ্ছতা দূর করিবার কর্তব্যটি সম্পাদন করিবার ঝোঁকে সরকার সেই স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করিতে আরম্ভ করিবে, তেমন সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। এই কারণেই, ‘স্ব-নিয়ন্ত্রণ কমিশন’-কে বিকাশ ভবন হইতে শত হস্ত দূরে রাখাই বিধেয়। বস্তুত, সেই কমিশনে কে কে থাকিবেন, তাহা স্থির করিয়া দেওয়াও সরকারের কাজ নহে। স্ব-নিয়ন্ত্রণই যখন, স্কুলগুলিই না হয় ঠিক করুক। স্কুলগুলি যাহাতে তথ্য জানাইতে বাধ্য হয়, কমিশনই সে ব্যবস্থা করুক। সরকার দূরে থাকুক। নচেৎ আশঙ্কা থাকিয়াই যায়, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ বাঁধিয়া দেওয়ার ন্যায় বেসরকারি স্কুলের বেতনও সরকারই স্থির করিতে আরম্ভ করিবে। মূল্য নির্ধারণের কাজটি বাজারের, সরকারের নহে। শিক্ষার বাজারটি যাহাতে যথাযথ ভাবে কাজ করিতে পারে, সরকার তাহা নিশ্চিত করিতে পারিলেই যথেষ্ট হয়। তথ্যের সমতাবিধান, অস্বচ্ছতা দূর করা, স্কুলগুলিকে অভিভাবকদের নিকট দায়বদ্ধ করা, সবই বাজারের পথ মসৃণ করিবার প্রকরণ। সরকার স্ব-নিয়ন্ত্রণ কমিশন গড়িয়া দিয়াছে, এই বার কমিশন বাকি কাজগুলি করিবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের আর কিছু করণীয় নাই।
বেসরকারি হাসপাতালের প্রসঙ্গটি স্বভাবতই আসিতেছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, স্কুল এবং হাসপাতাল এক নহে। হাসপাতালের ক্ষেত্রে রোগীর নিকট চয়নের সক্ষমতা, এবং বিশেষত একটি হাসপাতাল ছাড়িয়া অন্য হাসপাতালে যাইবার ক্ষমতা যতখানি সীমিত, স্কুলের ক্ষেত্রে তাহা নহে। স্কুলে অস্বচ্ছতার পরিসরও হাসপাতালের তুলনায় সীমিত। ফলে, হাসপাতালের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের যুক্তি যতখানি প্রয়োগ করা চলে, স্কুলের ক্ষেত্রে ততখানি অবকাশ নাই। স্কুলগুলিকে তথ্যপ্রকাশে বাধ্য করা গেলেই যথেষ্ট। তাহার পর বাজারই তাহার মূল্য নির্ধারণ করিয়া দিবে। এবং, স্কুল যে শুধু পরিকাঠামো নহে, শিক্ষার গুণগত মান এবং ঐতিহ্যও যে অতি জরুরি মাপকাঠি— তাহাও ভুলিলে চলিবে না। এই জিনিসগুলি মাপিবার মতো দাঁড়িপাল্লা সরকারের হাতে নাই। বাজারের নিয়মে মূল্য নির্ধারিত হইলে অনেক সহজে এই মাপের অতীত বিষয়গুলির মূল্যায়ন হয়। কাজেই, দায়িত্বটি বাজারের হাতেই থাকা বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy