অপচয়ের প্রধান কারণ সরকারি কর্মীর দুর্নীতি নহে। সরকারের ভ্রান্ত নীতি। পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি ওরফে অজানা জ্বরের তাণ্ডব তাহা ফের প্রমাণ করিল। জেলায় জেলায় ‘সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল’-এর বিশাল অট্টালিকায় তালা ঝুলিতেছে। আর জেলা হাসপাতালে স্থান না পাইয়া মরিতেছে রোগী। স্থান পাইলেও তাহার কী দশা হইবে, দেখাইল বড়জিরাটপুরের টুম্পা দাসের মৃত্যু। মেঝেতে শয্যা দিয়া স্যালাইন চালাইয়া দেওয়াই কি জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা? ইহাই কি সরকারি হাসপাতাল হইতে রোগীর প্রত্যাশা? সরকারের নিকট প্রশ্ন, কেন খাতায়-কলমে শয্যা বাড়িলেও কার্যত শৌচাগারের পাশে শয্যা পাতিতে হয় অসুস্থ মানুষকে? অচল হাসপাতাল নির্মাণে কোটি কোটি টাকা খরচ না করিয়া, সচল হাসপাতালগুলিকে অধিক কার্যক্ষম করিবার নীতি লইতে পারিত সরকার। কিন্তু ডেঙ্গি সংকট এখন আরও বৃহত্তর একটি সমস্যার দৃষ্টান্ত হইয়া উঠিল। তাহা হইল, দুর্বল চিকিৎসা পরিকাঠামো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে হাসপাতালগুলিকে ‘উন্নত’ করিবার বিষয়ে বহু বার বহু ঘোষণা হইয়াছে। হাসপাতালের বাহিরের বোর্ডে মহকুমা হাসপাতাল জেলা হাসপাতাল হইয়াছে, এমনকী সুপার স্পেশ্যালিটিও হইয়াছে। কিন্তু রোগীর দুর্ভোগ কমিয়াছে কি? যে হাসপাতালে ন্যূনতম যে চিকিৎসাগুলি পাইবার কথা, সেগুলো কি মিলিতেছে? যে চিকিৎসাগুলি ব্লক, মহকুমা স্তরে পাইবার কথা, সেগুলি এখনও জেলা সদরের হাসপাতালে বা কলকাতায় ‘রেফার’ করা হইতেছে। এমনকী এক জেলা হাসপাতাল হইতে অন্য জেলা হাসপাতাল, এক মেডিক্যাল কলেজ হইতে অপর মেডিক্যাল কলেজে রোগীকে পাঠানো হইতেছে। কয়েকটি হাসপাতালে রোগী উপচাইয়া পড়িতেছে। তখন রোগীর সংখ্যাধিক্যকে অবহেলার ‘কারণ’ বলিয়া দেখাইতেছে হাসপাতাল।
বারাসাত জেলা হাসপাতাল এমনই ব্যাখ্যা দিয়াছে স্কুলছাত্রী দেগঙ্গার রুকসানা খাতুনের মৃত্যুর। সকালে যে ভর্তি হইয়াছে, তাহাকে সারা দিন মেঝেতে রাখিয়া রাত একটায় অতি-মুমূর্ষু অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজে ‘রেফার’ করা হইল, ‘রোগীর চাপ’-ই নাকি তাহার কারণ। রোগীদের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করিবার পরিকাঠামো হাসপাতালে নাই বলিয়াই চাপ বাড়িলে ভাঙিয়া পড়ে হাসপাতালের পরিষেবা। অতিরিক্ত ব্যয়ে উন্নততর প্রযুক্তি আনিয়া বাহবা পাইতে সরকারের যত উৎসাহ, মৌলিক পরিষেবা নিশ্চিত করিতে ততখানি নহে। এই কারণেই ডেঙ্গি এতগুলি প্রাণ লইতে পারিল। উন্নয়নের ভোজবাজি দেখাইবার ঝোঁকে নেতারা নিত্যনূতন ‘নীতি’ ঘোষণা করিতে পারেন, কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা তাঁহাদের কর্তব্য বিস্মৃত হইতে পারেন না। বারাসাত ও বসিরহাট, এই দুটি জেলা হাসপাতালের কাজের মূল্যায়ন প্রয়োজন।
ডেঙ্গির মোকাবিলায় চিকিৎসা ব্যবস্থা যে ব্যর্থ হইয়াছে, বহু অকালমৃত্যু তাহার সাক্ষী। অবশ্য সকল মৃত্যুর শংসাপত্রে ‘ডেঙ্গি’ কথাটি লেখা হয় নাই। তাহা রোগীর মৃত্যুর ডেঙ্গিতে না হইবার কারণে, নাকি যথাসময়ে যথাযথ রক্তপরীক্ষা না হইবার কারণে, অথবা ‘ডেঙ্গি’ না লিখিবার জন্য চাপের কারণে, কেহ জানে না। সত্যকে ঘুলাইয়া দিয়া দায় এড়াইবার চেষ্টা করিল রাজ্য সরকার। ইহা রাজনীতি, স্বাস্থ্যনীতি নহে। কেনই বা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা রাজ্যবাসীর টাকায় পালিত হইয়াও তাহাদের প্রাণের প্রতি উদাসীন, বরং রাজনৈতিক নেতাদের তোষণ করিয়া নিজেদের আসন বাঁচানোই সর্বোচ্চ কর্তব্য বলিয়া মনে করেন, সেই জবাবদিহিও তাঁহাদের করিতে হইবে। তাঁহাদের মেরুদণ্ডটি যথাস্থানে থাকিলে বহু মানুষের প্রাণ থাকিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy