যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবী বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র হইতে এই মুহূর্তে একটি ‘আন্দোলন’ জন্ম লইতেছে। চলতি বৎসরের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে ভাবে দেশের বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রের সরকারি অর্থানুকূল্য বিপুল হারে কমাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত জানাইয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করাই সেখানকার সবে ঘটিয়া-যাওয়া কনভেনশনটির লক্ষ্য। এই প্রতিবাদ সভা প্রথমেই স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে যে, কেন্দ্রীয় সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে কেবল এই বিশেষ মানবী বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রটি চালানোই কঠিন হইয়া পড়ে নাই, গোটা দেশ জুড়িয়া আরও অনেক উইমেনস স্টাডিজ সেন্টার, আরও অনেক দলিত গবেষণা কেন্দ্র, আরও অনেক বিশিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত গবেষণা কেন্দ্র উঠিয়া যাইবার জোগাড় হইয়াছে। কেন এই কেন্দ্রগুলির অর্থসাহায্য অকারণে কমাইয়া ইহাদের বিপদে ফেলিবার চেষ্টা? একটিই ব্যাখ্যা সম্ভব। বর্তমান ইউজিসি মনে করিতেছে, সামাজিক ভাবে ‘প্রান্তিক’ বিষয়গুলি লইয়া এত আলোচনা-গবেষণার দরকার নাই! এবং ইউজিসি যেহেতু কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নীতিবাহী সংস্থা, ইহার পিছনে সরাসরি বিজেপি রাজনীতির প্রতিফলন দেখা যাইতে পারে। মহিলা, দলিত, জনজাতি, ইত্যাকার বিষয়গুলিকে সমাজের মূল স্রোতে বেশি আনিলে এক ধরনের রাজনীতির সমস্যা বাড়ে—বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই ধরনের রাজনীতিই করিয়া থাকে। তাই রাজনীতির পরিবর্ত রাজনীতি তৈরি না করিলে সমস্যা সমাধানের কোনও আশা নাই। যাদবপুরের কনভেনশন হইতে সেই প্রতিবাদী রাজনীতির বার্তাই বাহির হইয়া আসিতেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এত দিনে পরিষ্কার করিয়া দিয়াছেন যে, তাঁহার উচ্চারিত বাণীর সহিত তাঁহার সরকারের কাজকর্মের যোগ খুঁজিলে হিমালয়সমান ভুল হইবে। সহিষ্ণুতার বুলি দিয়া তিনি বক্তৃতার ভার বাড়াইবেন, এ দিকে তাঁহার দলীয় সাঙ্গোপাঙ্গরা অমিতবিক্রমে গোরক্ষার নামে অশান্তি-সংঘর্ষের ধার বাড়াইয়া চলিবেন। একই ভাবে, প্রধানমন্ত্রী ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর বাণী বিতরণ করিবেন, অন্য দিকে তাঁহার সরকারি দফতর একটি-একটি করিয়া জনগোষ্ঠীভিত্তিক গবেষণাকেন্দ্র বন্ধ করিবে। দলিতদের ক্ষেত্রেই এই বিচ্যুতিটি সর্বাপেক্ষা পরিষ্কার। ক্ষমতালাভ ইস্তক প্রধানমন্ত্রী দলিত বিকাশের বড় বড় আলংকারিক প্রতিশ্রুতি দিয়া আসিয়াছেন, অম্বেডকরের মূর্তি নির্মাণের ঢল বহাইয়াছেন, কিন্তু দলিত গবেষণা কেন্দ্রগুলি দ্রুত বন্ধ করিবার আয়োজনও পাশাপাশিই চলিতেছে। মানবীচর্চার বিষয়টিও তাই। মূল লক্ষ্যটি এক। মানবিক বিদ্যা অর্থাৎ হিউম্যানিটিজ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা গবেষণা কমাইলে সমাজে মুক্ত গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার পরিসরটিও নিয়ন্ত্রিত হইবে। মুক্ত গণতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যে লিবারেল সমাজদর্শনের অবারিত প্রবেশ ও প্রভাব, তাই ইহার গোড়ায় কুঠার মারাই বিজেপি-শাসিত সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে গবেষণা হইবে, সরকারি সিলমোহরযুক্ত সংস্থা আদৌ কেন তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবে— ইহা প্রথম প্রশ্ন। গবেষণা কেন্দ্রগুলি সরকারি অর্থসাহায্য পায় বলিয়া মূল্যায়নপদ্ধতি চলিতে পারে, কিন্তু মূল্যায়নের নামে যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ কেন চলিবে: ইহা দ্বিতীয় প্রশ্ন। এক সরকার আসিয়া একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কিছু কেন্দ্র তৈরি করিয়া দিবে, আর এক সরকার আসিয়া ত্রয়োদশ পরিকল্পনায় সেই সব কেন্দ্রের মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিবে, এমন চলিতে পারে না। বিদ্যাচর্চা কিংবা সামাজিক গবেষণা ঠিক সরকারি দয়াদাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে না, সারস্বত ও সামাজিক অধিকারের উপর নির্ভর করে। পরের সপ্তাহে রাজধানীতে বৃহত্তর প্রতিবাদসভায় দেশের নানা প্রান্তের মানবীবিদ্যাচর্চার প্রতিনিধিরা মিলিত হইয়া সেই সামাজিক দায়বদ্ধতার দাবিটিই তুলিতে চলিয়াছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy