Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্দ ১

মমতা গরিবকে কী দিতে পেরেছেন

ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। সেই জন্যই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেন? ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে। এ নাকি ‘পপুলিস্ট’ নীতির জয়। যেখানে এত দারিদ্র, সেখানে জামা-জুতো-সাইকেল বিলি করলে ভোট তো মিলবেই— বাঁকা হাসি-চাপা িনশ্বাস মেখে কথাটা কানে আসছে।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০০:৫২
Share: Save:

ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। সেই জন্যই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেন? ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে। এ নাকি ‘পপুলিস্ট’ নীতির জয়। যেখানে এত দারিদ্র, সেখানে জামা-জুতো-সাইকেল বিলি করলে ভোট তো মিলবেই— বাঁকা হাসি-চাপা িনশ্বাস মেখে কথাটা কানে আসছে।

দারিদ্র কমানোই নেতার কাজ। গরিবের জন্য টাকা খরচ করে যদি সে কাজটা হয়, তা হলে সে তো ভাল রাজনীতি। ভোটের বাক্সে তার পুরস্কার মেলাই উচিত। কিন্তু গরিবকে সামনে রেখে টাকা খরচ করলেই যে সে টাকা দারিদ্র কমাবে, এমন তো নয়। মমতা সাড়ে সাত হাজার ক্লাবকে বছরে একশো কোটি টাকারও বেশি দিচ্ছেন। তাতে গরিবের কী? মাটি উৎসবে কৃষির জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রের টাকা খরচ হয়েছে। প্রান্তিক চাষির কী লাভ হয়েছে? মেলা-খেলা, ক্রিকেট তারকাদের সোনার গয়না, বিজ্ঞাপনে নেত্রীর ইচ্ছা-উদ্যোগের প্রচার— কোনওটায় গরিবের লাভ হওয়ার কথা নয়। এগুলো নিঃসন্দেহে চটকদারিতে লোককে খুশি করে ভোট টানার চেষ্টা।

অন্য দিকে, অন্তত তিনটে উদ্যোগের কথা বলা যায়, যা রাজ্যে দারিদ্র কমাতে পারে।

প্রথমটি খাদ্য সুরক্ষা। কেন্দ্রের খাদ্য নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে রাজ্যের নিজস্ব প্রকল্প জুড়ে দিয়েছেন মমতা। রাজ্যের নয় কোটি মানুষের প্রায় সাড়ে সাত কোটি সুলভ চাল-গমের আওতায় আসছেন। এঁরা সবাই হয়তো গরিব নন। কিন্তু খিদে আর অপুষ্টি রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গরিব বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়। এক তো যে কোনও সুযোগ পেতে গরিবকে কনুই দিয়ে ঠেলে এগিয়ে যায় বড়লোক। তার উপর অ-গরিব পরিবারের একটা মস্ত অংশের গায়ে খিদে-অপুষ্টি টিপছাপ দিয়ে রেখেছে। যার দু-তিন বিঘে জমি রয়েছে, কি নিজের পাকা ঘর, সরকারের চোখে সে গরিব নয়। কিন্তু কাল বাদে পরশু পাতে কী জুটবে, সে চিন্তায় তাদের অনেকের ঘুম হয় না। খাদ্যের জন্য যে ভর্তুকির টাকা গরিব পরিবারের কাছে যাচ্ছে— রাজ্য সরকার বাজেটে ধরেছে বছরে ১৪০০ কোটি— তার ফল শুধু তাৎক্ষণিক নয়। পুষ্টির জন্য মেধার বিকাশ, বাড়তি কর্মক্ষমতা, এগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন। রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প এবং খাদ্যসাথী প্রকল্প যদি ছেদহীন ভাবে কাজ করে, তা হলে দারিদ্র কমার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

দ্বিতীয়টি সুলভ ওষুধ। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান, আর সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ফ্রি, দুটোই গরিবের কাছে কাজের। বাজারের চাইতে এই সব দোকানে ওষুধের দাম কম রাখতে রাজ্য সরকার ২০১২ সাল থেকে ৬৬৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। সব ওষুধ ফ্রি এখনও মিলছে না, তবু আউটডোরে এখন মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ ফ্রি ওষুধ হাতে-হাতে মিলছে, বলছেন ডাক্তাররা। সরকার এই টাকাটা দেওয়ায় গরিবের যে খরচ বেঁচেছে, সেটাই একমাত্র লাভ নয়। খরচের ভয়ে যাঁরা চিকিৎসা এড়িয়ে যেতেন তাঁরা যদি হাসপাতালে আসতে সাহস পান, সেটাও মস্ত লাভ। ক্রনিক অসুখ কর্মক্ষমতা কমিয়ে দারিদ্র বাড়ায়। ওষুধে ভর্তুকি সেটা রুখতে পারে।

তৃতীয়টি বাস্তুজমির অধিকার। এ বিষয়টি নিয়ে বিশেষ প্রচার হয়নি। হয়তো তার কারণ এটা ঠিক বামফ্রন্টের ধাঁচে জমি খাস করে বিলি করা নয়। যাঁরা জমি দখল করে বাস করছিলেন, তাঁদের সেই সব জমির পাট্টা দেওয়া। ‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি’ প্রকল্পে এ অবধি ২ লক্ষ ১২ হাজার পরিবার পাট্টা পেয়েছে। এ ভাবে জমি দেওয়া ঠিক কি না, তর্ক হতে পারে। কিন্তু দারিদ্র কমাতে এটা কার্যকর। উদ্বাস্তু পরিবার মাত্রই বুঝবেন, এক টুকরো জমি কয়েক প্রজন্মের জীবন বদলে দিতে পারে। গরিব থেকে নিম্নবিত্ত, ক্রমে মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার যাত্রা ওই জমি থেকে শুরু হয়।

একশো দিনের প্রকল্পে কাজ বেড়েছে, রাস্তা ভাল হওয়ায় পণ্য বাজারে পৌঁছনো সহজ হয়েছে। এর ফলেও রোজগার বাড়বে গরিবের। তবু দীর্ঘস্থায়ী ফলের নিরিখে খাদ্য, ওষুধ আর জমিকে গুরুত্বে একটু এগিয়ে রাখা চলে।

অন্য দিকে, দারিদ্র কমাতে যে কাজগুলো না করলেই নয়, তেমন কিছু কাজে ব্যর্থ হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্প।

প্রথম স্কুলশিক্ষা। স্কুলছুটের হার এখনও ভয়াবহ। ২০০৬ সালে ২৩ লক্ষ ৮৮ হাজার পড়ুয়া ছিল প্রথম শ্রেণিতে। ২০১৬ সালে মাধ্যমিক দিয়েছে ১১ লক্ষ ৪৪ হাজার। অর্থাৎ, মোটা হিসেবে, প্রায় অর্ধেক পড়ুয়া স্কুল শেষ করেনি। শাসকরা বলতে পারেন, এই দশ বছরের অনেকটাই ছিল বাম আমল। প্রাথমিকেই যারা স্কুল ছেড়েছে, তাদের দায়টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়। কিন্তু সে সান্ত্বনাও নেই। জেলাওয়াড়ি হিসেব বলছে, এই আমলে প্রাথমিকে স্কুলছুটের হার বেড়েছে। ২০০৭-০৮ সালে যারা ছিল প্রথম শ্রেণিতে, চতুর্থ শ্রেণিতে (২০১০-১১) তাদের ২০ শতাংশ স্কুলছুট হয়েছিল। আর ২০১১-১২ সালে যারা প্রথম শ্রেণিতে, চতুর্থ শ্রেণিতে (২০১৪-১৫) তাদের ২৬ শতাংশ স্কুলছুট। লক্ষণীয়, শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হওয়ায় স্কুল পরিকাঠামোর জন্য অনেক বেশি টাকা বরাদ্দ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে। ২০০৬ সালের তুলনায় এখন ‘কেবল প্রাথমিক’ স্কুলগুলোতে ক্লাসঘরের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ, শিক্ষক বেড়েছে অন্তত ৭০ হাজার। তা সত্ত্বেও কেন স্কুলছুটের হার বাড়ছে? প্রশ্নটা নিয়ে সম্ভবত সরকারেরও অস্বস্তি আছে— গত তিন বছর ‘ইকনমিক রিভিউ’-তে শুধু ‘এনরোলমেন্ট’-এর পরিসংখ্যান মিলছে, ‘ড্রপ-আউট’-এর উল্লেখই থাকছে না।

শিক্ষায় মমতার প্রধান দুটি প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ ও ‘সবুজসাথী।’ দুটোরই লক্ষ্য উঁচু শ্রেণির পড়ুয়া। যা গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার মতো দাঁড়াচ্ছে। আর এক সমস্যা: কন্যাশ্রীর টার্গেট মেয়েরা। কিন্তু এ রাজ্যে স্কুলছুট ছেলেরাই বেশি। মাধ্যমিকের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট। সেরা জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে এ বছর মেয়েদের চাইতে ছেলে পাঁচ হাজার কম। মুর্শিদাবাদে ব্যবধান দশ হাজার। ব্যবধান প্রতি বছর বাড়ছে, বলছে সরকারি তথ্য। গরিবের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রকল্প খাপ খাচ্ছে না। অথচ গরিবের শিশু স্কুলছুট হওয়া মানে দারিদ্রের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

দ্বিতীয় ব্যর্থতা ছোট চাষি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের জন্য অন্তত তিনটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন: কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বিলি বাড়ানো, ন্যায্যমূল্যে ধান কেনার জন্য চেক, ব্লক কিষাণ মান্ডি নির্মাণ। কোনওটাই ফড়ে ও মহাজনের উপর চাষির নির্ভরতা কমাতে পারেনি। যার একটা ইঙ্গিত: সাম্প্রতিক জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যত গ্রামীণ পরিবারের নগদ ঋণ বাকি আছে, তাদের তিনটের একটাই ৩০ শতাংশেরও বেশি হারে সুদ দিচ্ছে। যা মহাজনের প্রতাপের প্রমাণ। ব্লক মান্ডিতে ফড়েরাই ধান বেচে চেক নিয়ে যান, সেটা গ্রামে ‘ওপেন সিক্রেট।’ আরও কেসিসি কার্ড বিলি, আরও বেশি টাকার ঋণ বিলির হিসেব দিয়ে লাভ নেই। কত পুরনো কার্ড বকেয়া ঋণের জন্য অকেজো, ঋণের টাকার কত অংশ প্রান্তিক চাষির কাছে যাচ্ছে, জানা না গেলে কী করে বুঝব, টাকাটা গরিবের কাজে লাগছে কি না?

ব্যাঙ্কের কর্তারা যা-ই বলুন, গ্রামে ঘুরলেই বোঝা যায় ছোট চাষি হয় চড়া সুদে ধার নিচ্ছে, নয় নিজের রোজগারের টাকায় কোনও মতে মন্দ মানের চাষ করছে। যে চাষি কেসিসি-র ঋণ নিচ্ছে, তারও পুরো প্রয়োজন মিটছে না, মহাজনের কাছে হাত পাততেই হচ্ছে। ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে ফড়েকে। গ্রামের প্রাথমিক কৃষি সমবায় সক্রিয় হলে কৃষিঋণ আর ন্যায্য মূল্যের চেক, দুটোই চাষির পক্ষে পাওয়া সহজ হত। কিন্তু মমতা সমবায়গুলো বামেদের থেকে দখল করতে যত আগ্রহ দেখিয়েছেন, সেগুলোকে সক্রিয় করতে তা দেখাননি। চড়া সুদের ঋণ প্রতি বছর আরও বেশি করে জড়াচ্ছে ৫০-৬০ লক্ষ চাষিকে। চাষ থেকে রোজগার বাড়লেও দারিদ্র ঘুচবে না তাদের। ঋণগ্রস্ত হয়েই মরতে হবে।

সমস্যার তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। এটুকু বোঝা গেলেই যথেষ্ট যে মুখ্যমন্ত্রী গরিবের কথা ভেবে যে সব প্রকল্প নিয়েছেন, তার সব ক’টাই গরিবের কাজে লাগেনি। প্রশ্ন উঠবে, শুরু না করলে বোঝা যাবে কী করে, কোনটা কাজ করবে? তার উত্তর, গোড়ায় ছোট পরিসরে পরীক্ষামূলক ভাবে দেখা যেত। আগে গোটা দশেক ব্লকে কিষাণ মান্ডি করলে বোঝা যেত, ছোট চাষি সেখানে ফসল বিক্রি করতে পারছে কি না। একসঙ্গে সব ব্লকে দু-কোটি টাকার তালাবন্দি ভূত-মান্ডি গড়ার দরকার ছিল না।

এ বার প্রয়োজন নিয়মিত অডিট। শুধু প্রকল্পের টার্গেট পূরণের সংখ্যা নয়, উদ্দেশ্য পূরণের হিসেব। কত সাইকেল বিলি হল, জানলেই হবে না। জানতে হবে কত ছাত্র স্কুলে আসছে। কত কার্ড বিলি হল, সে সংখ্যা অর্থহীন, যদি না জানা যায়, যত চাষি ধান-আলু বুনেছেন তাঁদের কত জন কৃষিঋণ পেলেন। মুখ্যমন্ত্রী যখন জেলায় যান, জনসভায় প্রশ্ন করেন, প্রকল্পের সুবিধে মিলছে কি না। কেউ ‘না’ বললে মঞ্চে-বসা অফিসারদের প্রশ্ন করেন, কী ঘটছে। এ-ও এক ধরনের অডিট। কাজে দেয়। আরও নিয়মমাফিক বিশ্লেষণ করে সে তথ্য প্রকাশ করলে গরিবেরও লাভ হবে, তাঁরও।

গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা বলে, এই স্বচ্ছতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। ‘৯৯ শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে’, ‘রাজ্য দুর্নীতি-মুক্ত,’ ইত্যাদি শুনতেই রাজ্যবাসী অভ্যস্ত। রাজ্য সরকার প্রকাশিত বিভিন্ন বার্ষিক রিপোর্ট, নানা দফতরের ওয়েবসাইট দেখলেও বোঝা যায়, সেগুলি হয় অসম্পূর্ণ, না হলে প্রচারধর্মী, সারহীন বিবৃতি। ফলে ব্যর্থতা লুকোতে গিয়ে সাফল্যের প্রমাণও চাপা পড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সত্যিটা চাপা থাকবে না। ২০২১ কেবল পরবর্তী বিধানসভা ভোটের বছর নয়, পরবর্তী জনগণনারও বছর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে এই রাজ্যে কতটা উন্নয়ন হয়েছে, তার দুধ-জল স্পষ্ট হয়ে যাবে তখন।

গরিবের উপর নির্ভর করে মুখ্যমন্ত্রী জিতেছেন। গরিব তাঁর উপর কতটা নির্ভর করতে পারে, এখন সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE