Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

হায় রে কবে কেটে গেছে রবিজননীদের কাল

রবি ঘোষ, কৌতুক অভিনেতার তকমা পরে যাঁকে বিচরণ করতে হত, বিশ বছর আগে প্রয়াত। ওই তকমাটি ভূষণ, না প্রহসন, তা নিয়ে এখনও মাঝে মাঝে ভাবি।

তবু প্রতিবাদ। রাজধানীর রাজপথ-এ অণ্ণা হাজারের ডাকে। অগস্ট ২০১১

তবু প্রতিবাদ। রাজধানীর রাজপথ-এ অণ্ণা হাজারের ডাকে। অগস্ট ২০১১

অশোক মিত্র
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রবি ঘোষ, কৌতুক অভিনেতার তকমা পরে যাঁকে বিচরণ করতে হত, বিশ বছর আগে প্রয়াত। ওই তকমাটি ভূষণ, না প্রহসন, তা নিয়ে এখনও মাঝে মাঝে ভাবি। রবি তাঁর অন্তরঙ্গ মহলে একটি বিশেষ কাহিনি বলতেন। উদ্বাস্তু পরিবার, বরিশালে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে এসেছেন, রবির বাবা জেলা আদালতে সামান্য সেরেস্তাদার, আদ্যোপান্ত সৎ প্রকৃতির মানুষ, চাকরিজীবনে একটি পয়সাও উপরি নেননি। জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বাড়ছে, বাড়িভাড়াও সেই সঙ্গে। ছ’-সাতটি সন্তান নিয়ে কী করে সংসার চালাবেন, সেই ভাবনায় রবির মা দিশেহারা। অথচ স্বামীকে গভীর শ্রদ্ধা করেন, শত প্রলোভন উপেক্ষা করেও মানুষটি অবিচল তাঁর প্রত্যয়ে। রবির একেবারে ছেলেবেলা থেকেই অভিনয়ের শখ। কিশোর বয়সেই উৎপল দত্তের সঙ্গে আলাপ ও শিষ্যত্ব গ্রহণ, পড়াশুনোয় আগ্রহ আছে, কিন্তু তা-ও প্রধানত অভিনয়কলা সংক্রান্ত গ্রন্থাদি পাঠাগার থেকে উদ্ধার করে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে পাঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম একটি-দুটি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতেই তাঁর পিতা প্রধান জেলা-বিচারকের কাছে আর্জি জানিয়ে একটি করণিকের পদে রবিকে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। রবির মাথায় হাত, অথচ উপায় নেই, জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে সংসারের কথা তাঁকে ভাবতেই হয়, নাট্যচর্চা ব্যাহত হতে বাধ্য। সংসারের দুর্গতি যথাসম্ভব কমানো পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে তাঁর কর্তব্য। যে দিন কাজে যোগ দেওয়ার কথা, তার আগের সন্ধ্যায় রবির মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কান্নাভরা কণ্ঠে ফিসফিস করে একটি অতি আর্ত উপদেশ দিলেন, ‘বাবুর মতো হইস না, একটু নিস-টিস।’ অস্ফুট কণ্ঠস্বর, অথচ যা রবির কাছে আর্তনাদের মতো শোনাল। এখানেই কাহিনিটির ইতি টেনে রবির অট্টহাস্য। আমরা যারা শুনছিলাম, নির্বাক হয়েই রইলাম।

অসহায়া জননী জানতেন, তিনি পাপাচার করছেন, ছেলেকে কু-উপদেশ দিচ্ছেন। সাংসারিক দুর্দশার কোন প্রত্যন্ত প্রান্তে গিয়ে ঠেকলে কোনও জননী সন্তানকে এমন পরামর্শ দিতে পারেন, তা বোঝা কঠিন নয়। এই বিশেষ ‘রবি-কাহিনি’টি গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। এই ছ’সাত দশকেই দেশ ও সমাজ পুরোপুরি পালটে গেছে। ‘নেওয়া-টেওয়া’ এখন আর পাপাচার নয়। একদা যা দুরাচার ছিল, তা এখন প্রায় সর্বগ্রাহ্য। জনগণের মুখে মুখে বার্তা ছড়ায়— অমুক মন্ত্রী এই উপায়ে দু’হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। অর্ধেকটা দলকে দিয়েছেন, বাকি অর্ধেক নিজের তহবিলে। অন্য এক মন্ত্রী নাকি অন্য এক বিশেষ প্রকরণে আরও বেশি টাকা নিজের পকেটে পুরেছেন। অবশ্য এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঠকিয়ে অসৎ উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির অভিযোগ অন্য এক রাজ্যের জেলা আদালতে দায়ের করা হয়েছিল। তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তার পর সশ্রম কারাদণ্ড, দু’দিন কারাগারে আটকও, তার পর স্বাস্থ্যের কারণে গৃহবন্দি। তাঁকে মন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হল। কিন্তু না, চিন্তার কারণ নেই, জেলা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্যের হাইকোর্টে আবেদন দাখিল। তবে ইতিমধ্যে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে অদলবদল, সাজাপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দলের সঙ্গে নবনিযুক্ত মন্ত্রিবর্গের দলের গভীর মিতালি। হাইকোর্টে দণ্ডিত মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সওয়ালে রাজ্য সরকারের কেমন যেন দায়সারা ভাব, ‘যথেষ্ট’ প্রমাণাভাবে হাইকোর্টে অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী খালাস। ঘটনার পরে সঙ্গে সঙ্গে ফের মন্ত্রী রূপে বহাল। যে রাজ্যে তাঁর বিচার হয়েছিল এবং তিনি শাস্তি পেয়েছিলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সেই রাজ্যের সরকার সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারতেন, কিন্তু গেলেন না। কারণ, বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না।

তালিকা বৃদ্ধি করে লাভ নেই। গন্ডা-গন্ডা এ রাজ্যের, ও রাজ্যের মন্ত্রীদের নামে অজস্র রটনা, কে রাতারাতি কত টাকা কী উপায়ে করেছেন। কোনও হেলদোল নেই, যেন সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। অবশ্য এখন তো ব্যাপারটি আর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, প্রশাসনিক রাজপুরুষরাও যেন মন্ত্রিমহোদয়-মহোদয়াদের অনুসৃত পথ ধরে এগোচ্ছেন। কেউ ধরা পড়ছেন, কারও বাড়িতে এত-এত সোনাদানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ইত্যাদি নানা গালগল্প। যা নিরেট বাস্তব, পুলিশ বা সেনাবাহিনীও এই বিশেষ ছোঁয়াচে রোগটি থেকে নিজেদের বাইরে রাখতে পারেনি।

এমন এক পরিস্থিতি, টেবিলের মুখোমুখি দুই প্রান্তে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা মনে মনে চিন্তা করতে বাধ্য ‘তুই চোর না মুই চোর’। নীচের শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এখনও হয়তো ছাপা হচ্ছে ‘বিত্ত হতে চিত্ত বড় এই ভারতের পুণ্য বাণী...’, জাতীয় ফলকে জ্বলজ্বল করছে সত্যমেব জয়তে, মহাত্মা গাঁধীকে এখনও জাতির জনক বলে সম্মান-শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর প্রথম পর্বে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কিংবা রাজপুরুষদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই ব্যক্ত হোক না কেন, তাদের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। মাঝেমধ্যে এক জন-দু’জন কর্তাব্যক্তির দুরাচার ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচার এবং কঠিন সাজাদান। তা ছাড়া, প্রশাসনের নিচু মহলে ইতিউতি যৎসামান্য ‘নেওয়া-টেওয়া’র ঘটনাবলি, যা আবহমানকাল থেকে চলে এসেছে। জাতীয় চেতনায় মনে হয় এটা প্রোথিত ছিল— আমরা দীন-দরিদ্র হতে পারি, কিন্তু অন্তত অসৎ আচরণকে প্রশ্রয় দিই না। অবশ্য এই অনুভবের মধ্যেও ঈষৎ দ্বিচারিতা। প্রশাসনিক স্তরে হয়তো তেমন দুরাচার নেই, কিন্তু সামাজিক ও আর্থিক শোষণ-পেষণ অব্যাহতই ছিল। ইত্যাকার শোষণ-পেষণ যত ক্ষণ আইনের গণ্ডির বাইরে বিচরণ করছে না, তত ক্ষণ কারও কিছু করার নেই।

গোটা চিত্রনাট্য এখন পুরোপুরি অন্য রকম। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো প্রায় অভ্যাসে পরিণত। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিও এই আচরণে ব্যতিক্রমী নয়, যা নিয়ে রাজ্যের সর্বোচ্চ বিচারালয় ও সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে। সবচেয়ে যা ভয়ংকর, খোদ বিচারক্ষেত্রেও দূষণ অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তুচ্ছ করা যাচ্ছে না। নিরীহ, নিরপরাধ, বিভিন্ন অনাচারে প্রহৃত নাগরিকের কোনও দিকেই আর ভরসা করবার মতো কিছু থাকছে না। তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কোনও কোনও মহলের অভিমত, সব মিলিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর দেশটা ভালয়-মন্দয় জড়াজড়ি করে ঢিমে তালে হলেও বেশ চলছিল, গোল বাধাল বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের শুরুতে, নব অর্থনীতির সরকারি ঘোষণা। দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদাত্ত আহ্বান জানানো— নানা নিয়মনীতির জটাজালে জাতীয় উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে, এখন থেকে অবাধ, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। এখানেই শেষ নয়, সরকারি বিবৃতিতে স্পষ্ট ইঙ্গিত— আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ ‘পশু-চেতনা’কে উদ্বুদ্ধ করি, ঝাঁপিয়ে পড়ি, লাফিয়ে পড়ি। ‘পশু-চেতনা’ ব্যাপারটা কী? সাধারণ পশুরা নাকি একমাত্র নিজেদের কথা ভাবে, স্বার্থচিন্তার বাইরে তাদের আগমন-নির্গমন নেই, অন্য জীবের মুখ থেকে আহার্য ছিনিয়ে নিয়ে নিজের উদরে পৌঁছতে তাদের দ্বিধা নেই। দরকার হলে, যার খাবার কেড়ে খেল, তাকে হত্যা করতেও দ্বিধা নেই।

এই ফরমানের ব্যাখ্যা নিয়ে অবশ্যই মতান্তর থাকতে পারে, কিন্তু অন্যতম সরল ব্যাখ্যা— প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে যে-কোনও উপায় অবলম্বনে বাধা নেই। একটি বিশেষ উদ্যোগে নেমে আপনি যদি মনে করেন, তাড়াতাড়ি কাজটি শেষ করে প্রতিযোগীদের হারিয়ে দিতে হলে কোনও সরকারি কর্মচারীকে উৎকোচ দান করে সমস্যার নিরসন ঘটাবেন, তা হলে তা-ও গ্রাহ্য। এ ধরনের উপসংহারে পৌঁছবার কারণও ছিল। আলতুফালতু কেউ নয়, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অভ্যন্তর থেকেই একটি প্রস্তাব প্রচারিত হয়েছিল— নব অর্থনীতির তাগিদে উৎকোচ গ্রহণ নিষিদ্ধ থাকলেও উৎকোচ প্রদান-কে আইনি মঞ্জুরি দেওয়া হোক। প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার স্বার্থে এটা প্রয়োজন। আমি যদি কোনও উপায়ে তড়িৎ গতিতে লক্ষ্যে পৌঁছই, তা হলে জাতীয় উপার্জনও উচ্চতর হারে উত্তীর্ণ হবে, অন্যেরা মরুক-বাঁচুক কিছু যায় আসে না, জাতির চরিত্র স্খলন ঘটছে কি না, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, একমাত্র লক্ষ্য দ্রুত দ্রুততর দ্রুততম বেগে উদ্দেশ্য পূরণ। জাতীয় আয়বৃদ্ধির জয় হোক, সম্মিলিত হয়ে আমরা সবাই ‘জয় জয় জয় হে’ বলব। শেষ পর্যন্ত যদিও এ রকম কোনও সংশোধন আইনি স্বীকৃতি পায়নি, হয়তো প্রবল প্রতিবাদ উঠছিল বলে কেন্দ্র থমকে গিয়েছিল, প্রস্তাবটির প্রভাব ব্যাপক হওয়া অবধারিত
ছিল। সরকারই তো ইঙ্গিত দিচ্ছেন— বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে শৈথিল্য বরণীয়, যদি তা জাতীয় উপার্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। অতএব হঠকারিতায় ভেঙে দাও ভীরু দ্বার। আসুন, সবাই জড়ো হয়ে আইন ভাঙার খেলায় মাতি।

এই গোছের তর্কবিতর্ক দেশের এই অরাজক অবস্থায় চলতেই থাকবে, কেউ কান পাতবেন, অধিকাংশই অন্যমনস্ক থাকবেন। আরও বড় লোষ্ট্রনিক্ষেপ, কে জানে, হঠাৎ কেউ করে বসবেন, আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় মস্ত কাপট্য বরাবরই ছিল, কপালে তিলক কাটি, কমণ্ডলুতে গঙ্গাজল, মুখে শাস্ত্রবাক্য উচ্চারণ, অথচ সত্তার সর্বস্ব জুড়ে পরস্ব অপহরণের চিন্তা। তবে শাস্ত্রবাক্যটিই গোলমেলে, এমনকী খোদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকুমারকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। কী বলছেন ভগবানজি? গীতার উপদেশাবলির একটি মহৎ ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই সম্ভব: পাণ্ডবরা ন্যায়প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে অবতীর্ণ। যে-কোনও যুদ্ধেই হত্যালীলা অবশ্যম্ভাবী, তাই বলে কেউ যদি গভীর মনোবেদনাবশত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেকে অপসারণ করতে চান, তা প্রকারান্তরে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে, সুতরাং অর্জুন দ্বিধাজড়িত প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকুন, অন্যথা পরোক্ষে তিনি অন্যায়কে সাহায্য করবেন।

তা হলে আমার-তোমার কারও প্রশ্ন করার অধিকার নেই? যা আমাদের করতে বলা হয়েছে, শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট হয়ে আমাদের তা করে যাওয়াই কর্তব্য? প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরা যে নির্দেশ দেবেন, বিনা প্রশ্নে বা প্রতিবাদে তা আমাদের মেনে নিতে হবে? আমাদের হাতের টাকা সাদা না কালো, সেই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আমরা যদি জানতে চাই যে তাঁরা নিজেরা সাদা কি কালো, তা হলে আমাদের বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হবে? আপাতত এই নিদারুণ প্রশ্নের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE