Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা: গরিব মানুষের বিশেষ লাভ হবে না

কুসংস্কারের স্বাস্থ্যনীতি

বিজেপির ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারেই ইঙ্গিতটি ছিল। এ-বারের বাজেটে তা আরও গভীর হল। ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশ্বাস— বলা ভাল, অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার।

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

স্বাস্থ্যনীতি ভাবনায় একটি বিপজ্জনক প্রবণতা ক্রমশই শিকড় গাড়ছে। বিজেপির ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারেই ইঙ্গিতটি ছিল। এ-বারের বাজেটে তা আরও গভীর হল। ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশ্বাস— বলা ভাল, অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার।

বিশ্বাসটি হল, সরকারি ব্যবস্থাপনায় আর সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবার জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। এহেন বিশ্বাসের কারণ কী? যুক্তিটি সরল— দেখাই যাচ্ছে দেশের বেশির ভাগ মানুষ আর সরকারি জায়গা থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিচ্ছেন না। অতএব সিদ্ধান্ত, তাঁদের সরকারি ব্যবস্থায় আস্থা নেই। আর, যদি সে আস্থা না-ই থাকে, তা হলে আর সরকারি ব্যবস্থায় টাকা ঢালবে কেন সরকার? মুশকিল হল, অসরকারি হাসপাতালে গিয়ে যে ঘটিবাটি বেচেও তল পাওয়া যাচ্ছে না! তা হলে উপায়? যুক্তি বলবে, সেই উপায় হল স্বাস্থ্যবিমা। কিন্তু বিমা দেখলেই তো হবে না, খরচা আছে! প্রিমিয়াম দিতে হবে না? গরিব মানুষ দেবে কোত্থেকে? অতএব, সরকারই দিয়ে দিক প্রিমিয়াম।

অল্প কথায়, এই হল স্বাস্থ্যনীতির বিপজ্জনক বাঁক। তবে এই ভাবনার ভগীরথ যে বিজেপি বা এনডিএ, তেমন দাবি করার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার ঢের আগে কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা (আরএসবিওয়াই) থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের ‘আরোগ্যশ্রী’— সবই এই মডেল। এই ধারা অনুসরণ করেই এ-বারের কেন্দ্রীয় বাজেটে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্প’ নামে একটি বিমা প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে গরিব পরিবারগুলির জন্যে। প্রায় দশ কোটি পরিবার এর সুফল পাবে বলে অর্থমন্ত্রীর দাবি। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ বিমা সংস্থা মিটিয়ে দেবে।

এর আপাত লক্ষ্য যদিও মানুষকে— বিশেষত দরিদ্র মানুষকে— আর্থিক বিপর্যয় থেকে বাঁচানো, তার পিছনে কিন্তু একটা অন্য লক্ষ্য প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সেই লক্ষ্য বাজারের প্রসারণ, যার ইঙ্গিত সরকারি দস্তাবেজে রয়েছে। এক দিকে যেমন বিমা কোম্পানিগুলির বাজার প্রসারিত হবে, অন্য দিকে অসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজারও চাঙ্গা হবে। অসরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবা শিল্পের বৃদ্ধির হার যে সাম্প্রতিক কালে অন্য সব শিল্পকে ছাপিয়ে গেছে, ২০১৭-র জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির খসড়ায় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই তার উল্লেখ আছে। মজার ব্যাপার, সেখানে এটাও বলা হয়েছে, বড় লগ্নির কর্পোরেট হাসপাতালকেই অসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আদর্শ হিসাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। চড়া দামের জন্যে মানুষজন যদি এই ‘আদর্শ’ শিল্পে উৎপাদিত পণ্যটি কিনতে অপারগ হয়, শিল্পটির বৃদ্ধিও হোঁচট খেতে থাকে। তা হলে উপায়? যাতে পণ্যটির বিক্রি অব্যাহত থাকে, দিনে দিনে বাড়ে, তা নিশ্চিত করার একটা উপায় তো খুঁজে বের করতেই হবে। সরকারি খরচে বিমা সেই কাজটিই করছে, এবং করবে।

আর্থনীতিক বৃদ্ধির মানদণ্ডে দেখতে গেলে বাজারের সম্প্রসারণে আপত্তির কোনও কারণ দেখি না। তাতে অর্থনীতির ভাল হওয়ারই কথা। কিন্তু অর্থশাস্ত্রই শেখায় যে-সব বাজার এক রকম নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, বিমার বাজার ও স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজার— দুটিই যারপরনাই ‘অন্য রকম’।

প্রথমে বলি স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজারের কথা। মাছের বাজারের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হল পণ্যটিকে ঘিরে তথ্যের অসাম্য। মাছের বাজারে ক্রেতা টিপেটুপে, গন্ধ শুঁকে মাছটা কেমন, তা আন্দাজ করতে পারেন। অর্থাৎ ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে তথ্যের অসাম্য সামান্যই। স্বাস্থ্য পরিষেবায় তা নয়। যে পণ্যটি ক্রেতা কিনতে চলেছেন তার গুণাগুণ তাঁর পক্ষে আগেভাগে জানা সম্ভবই নয়। এই তথ্যের অসাম্যের জন্যেই স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজারটি কখনও পূর্ণ প্রতিযোগিতার হয়ে উঠতে পারে না।

পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অনেক ক্রেতা এবং অনেক বিক্রেতা একই পণ্য কেনাবেচা করেন। ফলে কোনও বিক্রেতা বাজার নির্ধারিত দামের বেশি দাবি করলে ক্রেতারা অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যাবেন। মাছের বাজার অনেকটা সে-রকম। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজার, বিশেষত হাসপাতালে ভর্তি রেখে যে চিকিৎসা হয় তার বাজার, যেন একগুচ্ছ একচেটিয়া কারবারের মতো। প্রত্যেকেই যেন আলাদা আলাদা পণ্য বেচছে। এ এমনই এক পণ্য যে ঘুরে ঘুরে টিপেটুপে দেখে সর্বোৎকৃষ্ট বস্তুটি কেনার সুযোগ নেই তথ্যের অসাম্যের কারণে।

একচেটিয়া বাজারকে যে তার নিজের প্রবৃত্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না, তা অর্থশাস্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা। যেখানে একচেটিয়া বাজার অপরিহার্য, যেমন বিদ্যুৎ বণ্টন বা নলবাহিত পানীয় জল, সেখানে হয় সরকারকেই সেই দায়িত্ব নিতে হয়, অথবা অসরকারি মালিকানায় তা ছেড়ে দিলেও শক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজারে তথ্যের অসাম্যের কারণে কী পরিণতি হতে পারে এবং সরকার সে বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ করতে পারে, তা আজ আর অজানা নয়। তার কিছু কিছু সহজ, আবার কিছু অত্যন্ত দুরূহ।

অন্য দিকে, স্বাস্থ্য বিমার বাজারটিও কম জটিল নয়। এখানেও তথ্যের অসাম্য, তবে খানিকটা অন্য রকম। যিনি বিমা কিনছেন, তিনি নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে যতটা জানেন, বিমা সংস্থার পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। এক-এক জন মানুষের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা এক-এক রকম হতেই পারে। কিন্তু, কার অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ঠিক কত, বিমা সংস্থার পক্ষে তা পুরোপুরি আন্দাজ করা যেহেতু কঠিন, সংস্থা প্রিমিয়াম ধার্য করে গড় সম্ভাব্যতার হিসাবে। ফলে, যাঁদের অসুস্থতার সম্ভাবনা কম, তাঁদের পক্ষে প্রিমিয়াম বেশি হয়ে যায়। ফলত তাঁরা বিমা কিনতে চান না। যেহেতু কম অসুস্থতাপ্রবণ মানুষ বিমা করাবেন কম আর বেশি অসুস্থতাপ্রবণ মানুষই কোম্পানির কাছে ভিড় করবেন, ফলে বিমার গড় খরচ বেড়ে যাবে। আরও কম লোক বিমা কিনবেন।

অন্য দিকে, বিমা করা থাকলে মানুষ নিজের স্বাস্থ্যের যত্নও নেবে কম, ফলে অসুস্থতার সম্ভাবনাও বাড়বে, বিমা সংস্থার খরচও বেশি হবে, প্রিমিয়ামের অঙ্কও চ়ড়বে। বিমার বাজার দ্রুত না বাড়ার প্রধান কারণ এটাই। সরকার যদি প্রিমিয়াম দিয়ে দেয় তবে বিমাকারীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে বাড়বে, কিন্তু তথ্যের অসাম্যজনিত মুল সমস্যাটি থেকেই যাবে।

আবার, বিমাকারী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে হাসপাতাল তার অসুস্থতা ও চিকিৎসা সম্পর্কে যতটা জানে, বিমা সংস্থা জানে না। ফলে হাসপাতালেরও চেষ্টা থাকবে যে-কোনও উপায়ে বিমার পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করার। অপ্রয়োজনীয় হিসটেরেকটমি করে আরএসবিওয়াই–এর টাকা পকেটস্থ করার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। অতএব, বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকারি খরচে বিমার ব্যবস্থা হলে সরকারের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এক দিকে যেমন বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে, সে তুলনায় জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না।

সরকারি স্বাস্থ্যবিমা আর অসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র— এই যুগলবন্দি যে স্বতই বেসুরে বাজে, তার সামান্যতম স্বীকৃতিও সরকারি দস্তাবেজে এ পর্যন্ত দেখিনি। এই বিমামুখি ভাবনার প্রায় প্রতি ধাপেই যে অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে, আর তার সদুত্তর সরকারের কাছে না থাকলে নিদারুণ বিপদসংকুল বিমাসাগরে ঝাঁপ দিয়ে পড়া যে তেমন সমীচীন নয়— এ কথাটি কে কাকে বোঝাবে? রাজ্য থেকে কেন্দ্র, সব সরকারই আপাতত বিমার অপার মহিমায় আপ্লুত। অথচ ঘর থেকে দু’পা বাড়িয়ে একটু বাইরেটা দেখে নিলেই স্বাস্থ্যবিমার সর্বরোগহর গুণাবলির প্রতি আর তেমন আস্থা থাকে না। বিমা-ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থামাত্রই যে ব্যয়বহুল, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আমেরিকা। আরএসবিওয়াই বা বিভিন্ন রাজ্যের গরিবদের জন্যে বিমা প্রকল্পগুলির কেলেঙ্কারিগুলোও তো এখন আর অজানা নয়। অন্য দিকে, সরাসরি ব্যবস্থাপনায় পরিষেবার জোগান যে তুলনামূলক ভাবে কম খরচে অনেক মানুষকে পরিষেবা দিতে পারে, সে দৃষ্টান্তও রয়েছে। তাই সব জেনেও যখন বিমায় তনমনধন সমর্পিত হয়, সন্দেহ জাগে: প্রশ্নটা শুধু অজ্ঞতার নয়?

তা হলে কি নীতির পিছনে যে দর্শনটি প্রচ্ছন্ন রয়েছে, তারই সংকট? না কি সরকারি (মানে জনসাধারণের) অর্থে গোষ্ঠীবিশেষের উপকারসাধনের সেই পুরনো গল্প? হয়তো দুটোই। এক দিকে স্বাস্থ্যপরিষেবা ক্ষেত্রটিকে একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প হিসাবে দেখা— অন্য পাঁচটা কর্পোরেট শিল্পকে যে-ভাবে আর্থনীতিক প্রগতির পরাকাষ্ঠা হিসাবে দেখা হয়। আর অন্য দিকে, সরকারের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডকেও সেই একই ধরনের প্রগতির চশমা দিয়ে দেখা। এই দুই-এর অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে এই বিমামুখি ভাবনায়।

‘জনস্বাস্থ্যের জন্যে নীতি’ থেকে ‘অর্থনীতির জন্যে স্বাস্থ্যনীতি’তে এসে পড়লাম বুঝি আমরা। ভালমন্দের বিচার না করে স্বাস্থ্যনীতিকে যে এ-ভাবে অসরকারি উদ্যোগভিত্তিক আর্থনীতিক প্রগতির দর্শনের অন্তর্গত করে ফেলা হল, তা বিপদের কথা।

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অধিকর্তা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE