Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

চোখের বালি

রাষ্ট্র যাহা বলে, তাহাকেই শিরোধার্য না করিয়া রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করিতে শেখা, সেই সাহস অর্জন করা প্রকৃত উচ্চশিক্ষার অভিজ্ঞান।

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

হীরকরাজা কেন পাঠশালা বন্ধ করিতে উদ্‌গ্রীব ছিলেন, নরেন্দ্র মোদীরা বিলক্ষণ জানেন। একবিংশ শতকের ভারত অবশ্য এখনও ষোলো আনা হীরকরাজ্য হইয়া যায় নাই। ফলে, চাহিলেও তাঁহাদের পক্ষে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাঁপ ফেলিয়া দেওয়া কঠিন। অতএব, যত দূর করা যায়, কর্তারা তত দূরই করিতেছেন। গোলমাল বাধাইয়া প্রতিষ্ঠানগুলির গায়ে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’-র ফলক সাঁটিয়া দেওয়াই হউক, অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ইতিবাচক পক্ষপাত বন্ধ করাই হউক, গবেষণার সুযোগে কাটছাঁট করাই হউক অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটি হইতে ছাত্রপ্রতিনিধিদের ছাঁটিয়া ফেলা— যত ভাবে সম্ভব, দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বদলাইয়া দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত। যে উদার পরিসরটির জন্য জেএনইউ-এর ন্যায় প্রতিষ্ঠানের ‌খ্যাতি, সেই পরিসরটিকে ধ্বংস করিবার মরিয়া তাগিদ বড় বেশি দৃশ্যমান। ঘটনা হইল, ক্ষতি হইতেছে। দে়ড় বৎসরেরও অধিক সময় যদি কোনও প্রতিষ্ঠান অশান্ত থাকে, তবে ছাত্রসমাজে তাহার বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। উদারবাদী রাজনীতির পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে মানিয়া লইলে যদি খানিক শান্তিতে থাকা যায়, তবে অনেকেই হয়তো সেই শান্তি খুঁজিবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে মেধাবী ছেলেমেয়েরা জেএনইউ-এ পড়িতে যাইত তাহারা হয়তো অন্য বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজিয়া লইবে। প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ যদি না-ও করা যায়, তাহার চরিত্র বদলাইতে পারিলেও হীরকরাজার লাভ।

শুধু জেএনইউ নহে, অধুনা ভারতের যে কোনও উদারপন্থী, রাজনীতি-সচেতন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখন এই সংকটের সম্মুখীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিসর কেন স্বৈরাচারী শাসনের চোখের বালি, সেই কথাটি স্পষ্ট ভাবে না বলিলে এই সংকটের চরিত্র সম্পূর্ণ বোঝা অসম্ভব। যথার্থ শিক্ষা প্রশ্ন করিতে শিখায়। রাষ্ট্র যাহা বলে, তাহাকেই শিরোধার্য না করিয়া রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করিতে শেখা, সেই সাহস অর্জন করা প্রকৃত উচ্চশিক্ষার অভিজ্ঞান। শুধু ভারতে নহে, গোটা দুনিয়াতেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হইতে রাষ্ট্রের উদ্দেশে সর্বাপেক্ষা কঠিন প্রশ্নগুলি আসিয়াছে। অতএব, গণতন্ত্রে আস্থা নাই, এমন শাসকের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিপজ্জনক প্রতিস্পর্ধী পরিসর। যে নেতারা সঙ্ঘের পাঠশালায় শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত আলোচনায় সংযুক্ত হওয়া— ‘এনগেজ’ করা— আরও এক কারণে কঠিন। তাঁহারা যে শিক্ষায় শিক্ষিত, সেখানে প্রশ্নের অবকাশ নাই। সেখানে গুরুরা বলেন, ছাত্ররা শেখে। সেই শিক্ষায় আনুগত্য আছে, দ্বিমত হইবার স্বাধীনতা নাই; শৃঙ্খলা আছে, প্রতিবাদ নাই। ফলে, কী ভাবে ছাত্রদের প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হয়, নাগপুরের বিদ্যার্থীরা তাহা জানেন না। অতএব, যে কোনও প্রশ্নকেই তাঁহারা বিরুদ্ধতা হিসাবে দেখেন।

বিরুদ্ধ মতের সহিত আলোচনার পরিসর বজায় রাখিতে হইলে গণতন্ত্রের প্রতি যে আস্থা থাকা আবশ্যক, বর্তমান শাসকদের দৃশ্যত তাহা নাই। তাঁহাদের নিকট বরং বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠ রোধ করাই সহজতর। শুধু জেএনইউ-এর ন্যায় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানেই নহে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন বা রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় তুলনায় ছোট অথবা অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানেও একই ঘটনা ঘটিতেছে। শিক্ষার পরিসরে রাষ্ট্রীয় আধিপত্য স্থাপন করিতে পারিলে উগ্র জাতীয়তাবাদের দামামা বাজাইতে আরও খানিক সুবিধা হয়। তবে, হীরকরাজ্যের উদাহরণটি স্মরণে রাখা ভাল। শত চেষ্টাতেও কিন্তু উদয়ন পণ্ডিতকে হারানো যায় নাই। শেষ অবধি তাঁহার হাতের দড়ির টানেই রাজা খানখান হইয়াছিল। হীরকরাজা মনে রাখিবেন, উদয়ন পণ্ডিতরা মরে না। তাঁহাদের ছাত্ররাও অদম্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE