ঐত্রীর বাবা-মা।
ফের সেই মুখ। আঘাতের তীব্রতায় বিভ্রান্ত, শোকে উদ্গত-অশ্রু, শিথিল অধরে বিচারের প্রার্থনা। চিকিৎসা-বিভ্রাটে পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর অভিযোগ লইয়া মুখ্যমন্ত্রীর দরজায় আর কত বার দাঁড়াইবে বাংলার মেয়েরা? গত বৎসর ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য দেখিয়াছিল রুবি রায়কে। স্বামী সঞ্জয়ের মৃত্যুর জন্য এক বেসরকারি হাসপাতালের অর্থলিপ্সা ও গাফিলতিকে দায়ী করিয়া নবান্নে আসিয়াছিলেন তিনি। বৎসর না-ঘুরিতে সন্তান-শোকে অর্ধচেতন শম্পা দে হাতজোড় করিয়া বিচার চাহিতে গেলেন কালীঘাটে, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে। অন্য এক বেসরকারি হাসপাতালের গাফিলতিতে আড়াই বৎসরের কন্যাসন্তান হারাইয়াছেন তিনি, এমনই অভিযোগ। অতঃপর স্বাস্থ্য কমিশনের দফতরে শম্পাদেবীর ছবি, সন্তানহারা মা সেখানে প্রায় মূর্ছিত। সংবাদে প্রকাশ, অভিযুক্ত চিকিৎসক ছুটি লইয়া বাড়িতে। আশ্চর্য বটে। অভিযোগকারী বেদনা-বিবশ দেহ-মন লইয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে, অভিযুক্ত বিশ্রাম করিতেছে। এক বৎসরে কী পরিবর্তন হইল তবে? বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নূতন একটি কমিশন হইয়াছে। তদন্ত দ্রুত এবং নিরপেক্ষ হইবে, অতিরিক্ত খরচ করাইলে হাসপাতালের শাস্তি হইবে, চিকিৎসকও পার পাইবেন না, এমন অনেক আশ্বাস রাজ্যবাসী শুনিয়াছে। কাজ কী হইয়াছে? সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুতে আজও অ্যাপোলো হাসপাতালের কোনও চিকিৎসক কিংবা কর্মীর শাস্তি হয় নাই। এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি শাস্তির সুপারিশ করিয়া রিপোর্ট জমা দিয়াছে বহু পূর্বে, কিন্তু তাহা এখনও রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের বিচারাধীন।
স্বাস্থ্য কমিশন, মেডিক্যাল কাউন্সিল, স্বাস্থ্য দফতর, মুখ্যমন্ত্রীর দফতর, পুলিশ থানা প্রভৃতি নানা কর্তৃপক্ষের কাছে যে সকল অভিযোগ জমা পড়িয়াছে, তাহার কতগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি হইয়াছে, কত জনের শাস্তি হইয়াছে, রাজ্যবাসী জানে না। বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সফল হয় নাই, না কি সাফল্যের প্রচার হয় নাই? আশঙ্কা হয়, সরকার ব্যর্থ। কারণ প্রশাসনের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের আভাস পাইলে যে কোনও ব্যবস্থা সংযত ও তৎপর হইয়া ওঠে। বিচার ও শাস্তির সম্ভাবনা নিশ্চিত হইলে ত্রুটি সংশোধনের প্রবণতা দেখা দেয় পরিষেবায়। এ ক্ষেত্রে তাহা হয় নাই। আজও রোগীর আত্মীয়েরা বেসরকারি হাসপাতালের হৃদয়হীন আচরণে বেদনার্ত, চিকিৎসকের ঔদাসীন্য ও হাসপাতালের অযৌক্তিক খরচে ক্ষুব্ধ। তাহার অর্থ: হাসপাতালের কর্তারা রীতিনীতি পরিবর্তনের কোনও তাগিদ অনুভব করেন নাই। কিছু দিন শোরগোলের পর সব ‘ম্যানেজ’ হইয়া যাইবে, হয়তো এক বৎসরে এমনই অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন। অপর দিকে, সরকারের তর্জন-গর্জনকে নামীদামি হাসপাতাল মূল্য দেয় না, নাগরিকের মনে এই ধারণা ক্রমশ দৃঢ় হইতে বাধ্য। ফলে তাৎক্ষণিক বিচার লাভের আশায় ভাঙচুর, মারধরের রাস্তা বাছিয়া লইবে রোগীর আত্মীয়রা, সেই সম্ভাবনা কমিবার আশা সামান্যই। এমনকী বিচারের দাবিতে বিশৃঙ্খলা বাড়িতেও পারে। প্রশাসনের উপর আস্থা হারাইলে নাগরিক নিজের হাতে আইন তুলিয়া লইতে চায়, তাৎক্ষণিক প্রতিকার দাবি করে, ইহা পরীক্ষিত সত্য।
প্রশাসনের কর্তারা দাবি করিয়াছে, তাঁহারা সন্তানহারা বাবা-মায়ের পাশে আছেন। কিন্তু তাঁহারা অভিযুক্তদের বিপরীতে আছেন কি? পরিস্থিতি দেখিয়া আশঙ্কা হয়, যথাযথ বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা চালু করিয়া চিকিৎসক কিংবা হাসপাতাল মালিকদের চটাইবার সাহস প্রশাসনের নাই। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে সংবাদমাধ্যমে যে সকল গুরুতর চিকিৎসা-গাফিলতির অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহার কোনওটিতে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পূর্ণ হয় নাই, শাস্তিও হয় নাই। তবে কি যেমন চলিতেছে, তেমনই চলিবে? স্বজনহারার শোকে প্রাতরাশ সারিবে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা। সাংবাদিকের সম্মুখে যাঁহারা অভিযোগকারীর পাশে দাঁড়াইবেন, আড়ালে তাঁহারাই দাঁড়াইবেন অভিযুক্তের পাশে। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে হাতজোড় করিয়া বিচার ভিক্ষা করিতেছেন সন্তানহারা মা, এই ছবি গণতান্ত্রিক প্রশাসনের চরম লজ্জা। অথচ সেই ছবিকেই আজ ‘মানবিক প্রশাসন’-এর শংসাপত্র বলিয়া দাবি করা হইতেছে। ভয় হয়, মুখ্যমন্ত্রীর দরজায় শোকার্ত জননীর কান্নার দৃশ্য বারংবার দেখিতে হইবে।
যৎকিঞ্চিৎ
বাংলার বিভিন্ন জেলখানায় কোথাও বন্দিরা পালাচ্ছেন, কোথাও প্রকাণ্ড মারামারিতে সবার মাথা ফাটছে, কোথাও হিটার জ্বালিয়ে তেড়ে চা-কফি পোলাও-মাংস রান্না হচ্ছে। চোরাপথে মাদক ও মোবাইল তো ঢুকছেই। অর্থাৎ জেলবন্দিদের মন ভাল রাখতে রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের আর অত প্রয়োজন নেই। জেলের বাইরের সমাজের সঙ্গে পার্থক্যও ঘুচে আসছে। প্রকৃত উদার ও প্রগতিশীল সমাজ ছাড়া এ জিনিস হয়? এ বার এই ‘হ্যাপেনিং’ স্থানে টিকিট কেটে নিউ ইয়ার পার্টির ব্যবস্থা হোক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy