অধিকার?: পরিবাহী তার থেকে বিদ্যুৎ চুরি করার প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের সব প্রান্তেই কম-বেশি রয়েছে।
খুনের মামলায় যদি শাস্তি না হয়, বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাবেন কী করে? ‘হ য ব র ল’-র যুক্তি নয়— বিহেভিয়রাল ইকনমিকস বা আচরণবাদী অর্থনীতির তত্ত্ব বলবে, এটা একেবারে গোড়ার কথা। যে দেশে বড় অপরাধেরও শাস্তি হয় না, বা সময় লাগে বিস্তর, সেখানে খুচরো অপরাধের বাড়বাড়ন্ত হবেই। বিদ্যুৎ চুরি একটা খুচরো অপরাধ বই তো নয়। বিহারেই যেমন। পরিসংখ্যান বলছে, সে রাজ্যে কনভিকশন রেট, অর্থাৎ দণ্ডবিধির ধারায় অভিযুক্তদের মধ্যে যত শতাংশের শাস্তি হয়, সেই হার একশো জনে মাত্র দশ জন। আর, সে রাজ্যে যত বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়, তার ৫৫% চুরি হয়ে যায়।
বিদ্যুৎ চুরির মাপকাঠিতে অবশ্য গোটা দেশই বেশ এগিয়ে রয়েছে। গোটা দুনিয়ায় বিদ্যুৎ চুরির রাজধানী হল ভারত। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান— সে বছর সারা দুনিয়ায় মোট প্রায় ৯০০০ কোটি ডলারের বিদ্যুৎ চুরি গিয়েছিল। তার মধ্যে ভারতেই চুরি হয়েছিল ১৬২০ কোটি ডলারের বিদ্যুৎ। তালিকায় ভারতের পরে ছিল ব্রাজিল (চুরির পরিমাণ ১০৫০ কোটি ডলার) এবং রাশিয়া (৫১০ কোটি ডলার)। ভারতে কনভিকশন রেট চল্লিশ শতাংশের আশেপাশে। রাশিয়ার সরকারি পরিসংখ্যান যদিও বলছে যে সে দেশের কনভিকশন রেট ৯৯%, কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারি পরিসংখ্যানে বিশ্বাস করে, এমন কারও খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি বলেই খবর। মোট কথা, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে, এই বিশ্বাসটি এই দেশগুলোয় তেমন জোরদার নয়।
মানুষ যদি বিশ্বাস করে যে অপরাধ-টপরাধ সব ‘চলতা হ্যায়’, দুর্নীতিই দেশের ধর্ম, তা হলে খুচরো অপরাধ করার প্রবণতাও বাড়ে। দেশের দুর্নীতির পরিমাণ সম্বন্ধে মানুষের কী ধারণা, করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স নামের সূচক তা মাপে। সেই সূচকে ভারত আর ব্রাজিল ৭৯ নম্বরে, রাশিয়া ১৩১ নম্বরে— অর্থাৎ, এই দেশগুলোর নাগরিকরা বিশ্বাস করেন, সবার ওপরে দুর্নীতি সত্য। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস বা জাপানের কথা ধরুন। করাপশন পারসেপশন ইনডেক্সে এই দেশগুলো আছে যথাক্রমে ৭, ৮ আর ২০ নম্বরে। তিনটে দেশেই বিদ্যুৎ অপচয়ের পরিমাণ ছয় শতাংশের কম। জাপানে কনভিশকন রেট ৯৯ %, আর সিঙ্গাপুরে পুরো ১০০%। দেশ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, জনতারও তবে আর চুরি করতে হাত কাঁপে না।
পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা বা স্থানীয় দুর্নীতি সম্বন্ধে কুকথা বলে বিপাকে পড়তে চাই না— শুধু এটুকু বলি, সম্প্রতি জানা গেল, রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় একশো টাকার বিদ্যুৎ জোগান দিলে বণ্টনকারী সংস্থার ঘরে ফেরত আসে ত্রিশ টাকার কাছাকাছি। বাকি সত্তর টাকার বিদ্যুৎ বেমালুম চুরি হয়ে যায়। দুর্নীতির গল্পে সব সময়ই রাজনীতির সংযোগ থাকে। নেতারা ভোটের প্রতিদানে এই জাতীয় খুচরো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কর্মীরা হুকিং খুলতে এলে যেমন তাঁদের ঘিরে ধরে হেনস্থা করাটাই দস্তুর। এমনকী, মারধরও সহ্য করতে হয় কপাল তেমন মন্দ হলে। রাজনীতির জোর না থাকলে এতখানি কি হয়? বন্যাত্রাণের ত্রিপল থেকে বিদ্যুৎ, সব গল্পই আসলে এই ক্লায়েন্টেলিজম-এর। অপরাধ বিষয়ে যেহেতু সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ দ্বিধা নেই— প্রত্যেকেই জানে, আর পাঁচ জন যখন খুচরো চুরি করে, তখন নিজে হাত গুটিয়ে থাকাটাই বোকামো— সেখানে ক্লায়েন্টেলিজমের গল্পটা চুরির পথ ধরেও চলতে থাকে। এটা তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব গল্প। উন্নত দুনিয়ায় ক্লায়েন্টেলিজম আর খুচরো চুরি এ রকম সমার্থক নয়।
ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের তারে বয়ে চলা বিদ্যুৎ একটা আশ্চর্য জিনিস। তার জোগান এক অর্থে অফুরন্ত। সর্ব ক্ষণ বয়ে চলেছে, সর্ব ক্ষণ হাজির, অথচ চোখে দেখা যায় না, আর নজরদারি করারও কেউ নেই— এমন জিনিস আর ক’টা হয়? ত্রিপল অথবা চাল চুরি করার একটা সীমা থাকে, যার বেশি চুরি গেলে স্থানীয় মানুষ আপত্তি করবেন— নিজেদের (ন্যায্য) ভাগে কম পড়ল বলে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সে বালাই নেই— কেউ ভাগ বসালেও আপাতদৃষ্টিতে অন্যদের ভাগ কমে না। কাজেই, বিদ্যুৎ চুরিতে আপত্তির মুখে পড়ার সম্ভাবনা কম।
বিদ্যুৎ চুরি আরও একটা কারণে সহজ। মানুষের অসততার মধ্যেও কয়েকটা ধাপ আছে। একটা বাচ্চা ছেলে এক বার ক্লাসে সহপাঠীর কলম চুরি করে ধরা পড়েছিল। স্কুলে ডাক পড়ে বাবার। বাড়ি ফেরার পথে বাবা ছেলের কান মুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘কলম চুরি করতে লজ্জা করল না? আমায় বলতে পারতিস। অফিসে গোছা গোছা কলম আসে, তোর যতগুলো লাগত, এনে দিতাম!’ অফিসের কলম নির্দ্বিধায় বাড়ি নিয়ে আসেন যত মানুষ, তাঁদের একটা খুব ছোট অংশই কিন্তু অফিসের ক্যাশবাক্স খোলা পেয়ে টাকা সরাবেন। চুরির নিরিখে টাকার সঙ্গে কলমের দূরত্ব যতখানি, দৃশ্যমান জিনিসের সঙ্গে অদৃশ্য জিনিসের দূরত্ব তারও বেশি। যে জিনিস চোখে দেখা যায় না, আমাদের অবচেতন ধরে নেয়, সেই জিনিস চুরি করাটা ঠিক ‘চুরি’ নয়। সচেতন হয়ে ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় মন, তা নয়। চুরির সঙ্গে যে অস্বস্তির বোধ জড়িয়ে থাকে, সেটাই কম হয়।
মনের দিক থেকে না হয় বিদ্যুৎ চুরি করা সহজ। কিন্তু, বন্যাত্রাণের ত্রিপল বা রেশনের চাল চুরি করতে গিয়ে প্রাণে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা যতখানি, ইলেকট্রিকের লাইনে হুকিং করে বিদ্যুৎ চুরি করতে গিয়ে প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। ঠিক কত গুণ, বলা মুশকিল। মনস্তত্ত্ববিদরা বলবেন, সেই কারণেই এই বিপুল ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিদ্যুৎ চুরি করে— ঝুঁকি ঠিক কতখানি, জানে না বলেই। কোনও মানুষের পক্ষেই কি জানা সম্ভব, হুকিং করতে গিয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ঠিক কত শতাংশ? ফলে, মানুষের মন একটা অন্য পথে হিসেব কষে। যে প্রশ্নের উত্তর অজানা, এবং জানার কোনও উপায় নেই, সেই প্রশ্নটার বদলে একটা সহজতর প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। এই ক্ষেত্রে যেমন সহজতর প্রশ্নটা হল, ‘আমার চেনাশোনার মধ্যে কেউ কি হুকিং করতে গিয়ে মারা গিয়েছে?’ অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নের উত্তর হবে, ‘না’। মানুষের মন এই উত্তরটাকেই বড় প্রশ্নের, উত্তর-না-জানা প্রশ্নের, উত্তর হিসেবে পড়ে নেয়। উত্তরটা দাঁড়ায়, ‘হুকিং করতে গিয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ অতএব, হুকিং চলতে থাকে।
বিদ্যুৎ চুরি করতে যাওয়া দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এখানেই মিলে যান ‘ওয়ান অ্যাবভ’-এর মতো দামি রেস্তোরাঁয় পার্টি করতে যাওয়া শহুরে উচ্চবিত্তরা। মুম্বইয়ে কিছু দিন আগে এই রেস্তোরাঁয় আগুন লেগে মারা গেলেন অনেক মানুষ। রেস্তোরাঁ বাছাই করার আগে তাঁরা নিশ্চয়ই মেনু দেখেছিলেন, পরিবেশ দেখেছিলেন। কিন্তু, অগ্নি-সুরক্ষার ব্যবস্থা দেখেছিলেন কি? এই প্রশ্নের অবধারিত উত্তর, না। শুধু তাঁরা নন, কেউ দেখেন না। কোনও রেস্তোরাঁ যদি নিয়ম করে, বিলের ওপর ১০% অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হবে অগ্নি-নিরাপত্তার জন্য (এবং, সত্যিই যদি টাকাটা সুরক্ষার কাজেই ব্যবহার করে, যার ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমবে)— খুব বেশি লোক কি বিনা প্রশ্নে এই বাড়তি টাকাটা দিতে রাজি হবেন? মনে হয় না। কারণ, রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার সময়ও আমরা জানি না, আগুন লেগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ঠিক কতখানি। প্রশ্নটা মনেও আসে না। অগ্নি-সুরক্ষার জন্য বাড়তি টাকা দাবি করে প্রশ্নটা মনে করিয়ে দিলে আমরা আবার সহজতর প্রশ্নের উত্তর খুঁজি— ‘চেনাশোনার মধ্যে কেউ রেস্তোরাঁর আগুনে মারা গিয়েছে কি?’ বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নের উত্তরও, ‘না’। কাজেই, মনও তার চেনা ছকে চলতে থাকে।
রেস্তোরাঁর প্রসঙ্গ আপাতত থাক। বিদ্যুৎ চুরি ঠেকানোর উপায় তবে কী? প্রাণের ভয়ে মানুষ বিদ্যুৎ চুরি করা বন্ধ করে দেবে, সে সম্ভাবনা কার্যত নেই। আশাবাদীরা বলবেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই ছবিটাকে বদলে দেওয়া যায়। প্রশ্ন হল, কোন স্তরের সদিচ্ছা? ধরা যাক, মুখ্যমন্ত্রী বলে দিলেন, বিদ্যুৎ চুরি তিনি বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু, তাঁর নির্দেশ, আর একেবারে পঞ্চায়েত স্তরে থাকা নেতার স্বার্থ যে মিলবে না— সেই নেতাকে নিজের সমর্থনের ভিত্তি ধরে রাখতে হলে কোনও না কোনও চেহারায় ক্লায়েন্টেলিজম চালিয়ে যেতেই হবে। আর, বিদ্যুৎ চুরিতে (পরোক্ষ) সমর্থন জানানো ক্লায়েন্টেলিজমের অন্যতম নিরাপদ পথ। কাজেই, সদিচ্ছাই যদি দরকার হয়, তবে সেটা চাই ওপরের স্তরে। চুরি আর ক্লায়েন্টেলিজমের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগটি ভাঙার স্তরে। দুর্নীতি জিনিসটা যে কোনও ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, তা প্রতিষ্ঠা করার স্তরে।
তার জন্য বড় দুর্নীতি ঠেকাতে হবে। যত ক্ষণ না দিনে ডাকাতির দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তত ক্ষণ অন্তত ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ দিয়ে খুচরো বিদ্যুৎ চুরি ঠেকানো যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy