Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চিকিৎসা সংকটের উৎস সন্ধানে

সভার অন্যতম বক্তা, বন্ধন ব্যাংকের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ প্রশ্ন তুললেন, সন্তানের পড়াশোনার জন্য বাবা-মা যে খরচ করেন, সেটা অনুদান না বিনিয়োগ?

সীমান্ত গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে এ রাজ্যে সম্প্রতি শোরগোল উঠেছিল। চটজলদি সমাধান-প্রত্যাশায় কেউ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসী মুনাফাবাজ মানসিকতাকে, কেউ বা খোদ ডাক্তারদেরই কাঠগড়ায় তুলে অতিসরলীকৃত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছিলেন। মা দুর্গার পায়ের নীচে ‘অসুর’ ডাক্তারদের মূর্তিও দেখা গিয়েছিল! উত্তেজনা থিতিয়ে এলে শুরু হয় আলাপ-আলোচনা। যে কোনও সমস্যার সমাধানে পৌঁছনোর সেটাই প্রথম ধাপ। তেমন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সম্প্রতি কলকাতায় আয়োজিত হয় একটা আলোচনাসভা। বিষয়: ‘অনুদান অথবা বিনিয়োগ— কল্যাণমুখী স্বাস্থ্যোদ্যোগে কোনটা উপযোগী?’

সভার অন্যতম বক্তা, বন্ধন ব্যাংকের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ প্রশ্ন তুললেন, সন্তানের পড়াশোনার জন্য বাবা-মা যে খরচ করেন, সেটা অনুদান না বিনিয়োগ? ব্যাপারটাকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখলে তাতে বাজার ঢুকে পড়বে, ঝুঁকির প্রশ্ন উঠবে, এমনকী পরিস্থিতি-বিশেষে পুরো লগ্নিটাই জলে যেতে পারে। তাঁর আর একটা প্রশ্ন, এ দেশের সাধারণ মানুষ টাকা জমানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপরেই বেশি ভরসা করেন, অথচ তাঁরাই শিক্ষা বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে নির্ভর করতে চান বেসরকারি ব্যবস্থার ওপর। এমনটা কেন হয়?

সভায় দুই চিকিৎসক বক্তা ছিলেন অভিজিৎ চৌধুরী ও কুণাল সরকার। ডাক্তার চৌধুরী চিকিৎসা ব্যবস্থাটিকে সম্পূর্ণভাবে সরকারের হাতে রাখার পক্ষপাতী। ডাক্তার সরকার সরকারি ব্যবস্থার সার্বিক দৈন্যের ছবি তুলে ধরে চিকিৎসায় বেসরকারি বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর দাবি তুললেন। সেই সময় চন্দ্রশেখরবাবুর ওই প্রশ্ন দুটো শ্রোতাদের ভাবতে বাধ্য করল।

শুধু আমাদের রাজ্য বা দেশ নয়, স্বাস্থ্য-ক্ষেত্রের কতটা সরকারের আওতায় থাকবে আর কতটাই বা যাবে বেসরকারি পুঁজির হাতে, সেই বিতর্কে গোটা পৃথিবীটাই আড়াআড়ি বিভাজিত হয়ে গিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওবামাকেয়ার’ বাতিল করে দিতে তৎপর ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পিছনে কি পুরোটাই ট্রাম্পের আগমার্কা স্বেচ্ছাচারিতা, না কি বাজারের চাপও আছে? অন্য দিকে, চিনও স্বাস্থ্য-বিষয়ে এখন পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ নীতিতে আস্থা রাখছে। সবার উপর বাজার সত্য? নোয়াম চমস্কিকে উদ্ধৃত করে ডাক্তার সরকার বললেন, আমরা যদি ভেবে থাকি যে, আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আমাদের শাসন করেন, তা হলে আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছি। পৃথিবীটা আসলে তারাই শাসন করছে যাদের উৎপাদিত পণ্য আমরা নিয়মিত ক্রয় করি।

অন্য দিকে, ডাক্তার চৌধুরী স্মরণ করিয়ে দেন, ‘স্বাস্থ্য-সচেতনতা’ আর ‘অকারণ রোগ-ভীতি’ এক জিনিস নয়। চিকিৎসার বিরাট বাজার আমাদের মানসিক সুস্থতাকেই সর্বক্ষণ চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। শহর-জোড়া বেসরকারি হাসপাতালের ঢাউস ঢাউস বিলবোর্ড আর বিজ্ঞাপনী প্রচারে তো সেই বহুবিধ ‘কাল্পনিক অসুস্থতার’ই মহিমা-কীর্তন। শ্রবণ-যন্ত্র থেকে হাঁটু প্রতিস্থাপন, অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি থেকে প্লাস্টিক সার্জারি— সবই আজ বাজারের মহিমায় ‘প্যাকেজে’ পরিবেশিত। ইনস্টলমেন্টেরও সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ‘গুরুগ্রাম-এর মেডিক্যাল মলগুলিই কি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণ করে দিতে চলেছে?’ প্রশ্ন তুললেন ডাক্তার চৌধুরী।

সুন্দরবন-বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ও সমাজকর্মী তুষার কাঞ্জিলাল আবার মনে করিয়ে দিলেন, পরিষেবার ক্ষেত্রটি শিক্ষা হোক বা স্বাস্থ্য, সরকারি হোক বা বেসরকারি, জনকল্যাণের আদর্শ থেকে তা যদি সরে আসে, তবে তাকে প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। এবং এখানেই আসে সরকারের সদিচ্ছার প্রশ্নটি। কর্নাটকে ‘আরোগ্রশী’, ‘যশস্বিনী’ প্রভৃতি সরকারি স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প গরিব মানুষের জন্য যথেষ্ট উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। এ রাজ্যেও সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা হয়। চালু হয়েছে ‘স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প’ও। কিন্তু চিকিৎসার বাজারে লগ্নিকারীদের বেলাগাম মুনাফা করার প্রবণতায় রাশ টানতে রাজ্য সরকার যে মোটের ওপর ব্যর্থ (নার্সিং হোমগুলিকে মুখ্যমন্ত্রীর ধমকানি সত্ত্বেও), তার প্রমাণ— স্বাস্থ্যসাথী বিমা-প্রকল্পে অংশীদার হতে ইচ্ছুক কি না জানতে চেয়ে সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রস্তাব পাঠালে বেশির ভাগ হাসপাতালই সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। পুঁজির কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ কিন্তু কোনও যথার্থ জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না।

চিকিৎসায় ব্যক্তিগত লগ্নিকে নাকচ করা যাবে না। রাতারাতি তো আর সরকারি হাসপাতালগুলির হাল ফেরানো সম্ভব নয়। কিন্তু বেসরকারি ব্যবস্থাকে বল্‌গাহীন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে দিলে বিপদ। রাশটা কারও না কারও হাতে রাখতেই হবে— স্মরণ করালেন সঞ্চালক, ডাক্তার সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়।

শেষ পর্বে দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে একটি প্রশ্ন উঠে এল। আজ আমাদের রাজ্যের প্রত্যন্ততম অঞ্চলের মানুষও মোবাইলে দৈনিক কমপক্ষে দশ টাকা রিচার্জ করে থাকেন। বছরে হাজার তিনেক টাকার স্বাস্থ্যবিমা করাতে তাঁর খুব একটা সমস্যা থাকার কথা নয়। সেই টাকা বাজারে খাটিয়েই তো সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজা সম্ভব!

বৈঁচি বিহারিলাল মুখার্জী’স ফ্রি ইনস্টিটিউশনে শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

medical crisis Treatment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE