বিমল গুরুঙ্গ।
পুলিশকর্মী অমিতাভ মালিক পুলিশ না হয়ে অন্য কোনও পেশাও বেছে নিতেই পারতেন। সে অবকাশ যথেষ্টই ছিল তাঁর সামনে। কিন্তু পুলিশই পছন্দ, পুলিশ হয়েই দেশের কাজে লাগার ইচ্ছা ছিল অদম্য। ইচ্ছাপূরণ হয়েছিল, সে আনন্দের বিষয়। কিন্তু চিরতরে দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত হয়ে যাবেন তরতাজা যুবক, পরিজনরাও ভাবতেই পারেননি। সম্ভবত অমিতাভ মালিক নিজেও এমন কোনও স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখেননি।
গিয়েছিলেন তাজা জোয়ান কর্তব্য পালনে। কিন্তু সে ভাবে আর ফিরলেন না। নিথর দেহ ফিরল পরিজনদের কাছে। রাষ্ট্রের জন্য কর্তব্যরত অবস্থায় অমিতাভ মালিকের মৃত্যু হল কোন পটভূমিকায়? গোর্খাল্যান্ডের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের নাম করে সশস্ত্র এবং হিংসাত্মক এক আয়োজনের পটভূমিকায়। অমিতাভের এই অত্মোৎসর্গকে তাই অপচয় বলে মনে হচ্ছে। অদম্য যে প্রাণশক্তিকে মহত্তর কাজে লাগানো যেত, স্বার্থান্বেষী সঙ্কীর্ণতার যূপকাষ্ঠে অকালেই তার বলিদান হয়ে গেল।
পুলিশকর্মী অমিতাভ মালিকের এই মৃত্যু কিন্তু বিমল গুরুঙ্গকে আরও বেশি বেকায়দায় ফেলল। বিমল গুরুঙ্গ তো পৃথক গোর্খাল্যান্ড গঠনের দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলনে নেমেছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলনে যে হিংসার স্থান নেই, তাও তিনি নিশ্চয়ই জানেন। তা হলে পাহাড়ে আগুন এমন দাউদাউ করে জ্বলল কেন? কেন বিস্ফোরণ হল? কেন গুলি চলল? কেন একের পর এক অস্ত্র কারখানার হদিশ মিলল? কেন একে-৪৭ পাওয়া গেল? কেন বিমল গুরুঙ্গের বিরুদ্ধে জঙ্গি যোগের অভিযোগ উঠল? কেন তিনি অন্তরালবর্তী হলেন? কেনই বা তাঁকে খুঁজতে গিয়ে তরুণ পুলিশকর্মীকে চিরতরে লুটিয়ে পড়তে হল?
রাজ্যের প্রশাসন তথা পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ অনেক দিন আগে থেকেই দাবি করছিল, বিমল গুরুঙ্গ গণতন্ত্রের পথে নেই। পৃথক গোর্খাল্যান্ড আদায়ের জন্য গুরুঙ্গ হিংসাত্মক আয়োজন শুরু করেছেন, সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে এবং মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, ভিন্রাজ্য থেকে এবং বিদেশ থেকে ইন্ধন আসছে— বার বার বলছিল পুলিশ। অভিযোগগুলো ভয়ঙ্কর। তাই অভিযোগের আঙুল ওঠা মাত্রই তা নস্যাৎ করতে সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল বিমল গুরুঙ্গের। তিনি কিন্তু সে সক্রিয়তা দেখাতে পারেননি। আরও জনসংযোগ বাড়িয়ে, পাহাড়ের জনমতকে নিজের পক্ষে আরও সংগঠিত করে বিমল গুরুঙ্গের দেখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, বলিষ্ঠ গণভিত্তির জোরে গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছেন তিনি। কিন্তু বিমল উল্টোটাই করেছেন, অন্তরালে চলে গিয়ে নিজেকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছেন প্রতিদিন একটু একটু করে। আর হিংসার আয়োজন নীরবে বাড়তে থেকেছে অস্থির পাহাড়কে ঘিরে। অবশেষে পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ের অভিযোগ গুরুঙ্গ অনুগামীদের বিরুদ্ধে, গুরুঙ্গকে পালানোর পথ দিতেই নাকি হিংস্র আক্রমণ পুলিশের উপর, তরুণ সাব-ইনস্পেক্টরের মর্মান্তিক মৃত্যু পাহাড়ে। পালানোর পথ কি সত্যিই রইল আর?
বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের যোগসাজসের অভিযোগ আগে শুধু পুলিশের মুখে শোনা যাচ্ছিল। এখন বিনয় তামাঙ্গরাও মানছেন, এমন যোগসাজস অস্বাভাবিক নয়। হিংসার চেহারাটা আচমকা বোধহয় অচেনা ঠেকছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কাছেও। গুরুঙ্গের থেকে তাই আচমকাই অনেকটা দূরে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মিরিক। গণতান্ত্রিক পরিসরে ফিরে আসার পথটা ক্রমেই কিন্তু কঠিন হচ্ছে বিমল গুরুঙ্গের জন্য।
রাজ্য সরকারের সঙ্গে তথা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি সঙ্ঘাতই বোধহয় চেয়েছিলেন জিটিএ-র প্রাক্তন মুখ্য কার্যনির্বাহী। ভরসা ছিল ত্রিপাক্ষিকে। রাজ্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক যদি নাও হয়, রাজ্য যদি নাও ডাকে বৈঠকে, তা হলেও সহায় হবে কেন্দ্র, দরজা খোলা থাকবে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের। এমনই হয়তো ভেবেছিলেন গুরুঙ্গ। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, তাতে বিমল গুরুঙ্গকে নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক আয়োজন করা অস্বস্তিকর হয়ে পড়ল কেন্দ্রের পক্ষে। ভয়ঙ্কর হিংসায় অভিযুক্ত গুরুঙ্গের পাশে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে গেল কেন্দ্রের শাসক দলের পক্ষে।
পায়ের তলার মাটিটা যে দ্রুত সরছে, বুঝতে কি পারছেন বিমল গুরুঙ্গ? বলেছিলেন তো আন্দোলনের কথা। এত হিংসার আয়োজন তা হলে কেন? গণতন্ত্রের পথেই যদি থেকে থাকেন, তা হলে পুলিশে এত আতঙ্ক কেন? বার বার যে কোনও মূল্যে পুলিশের নাগাল এড়িয়ে পালানোর চেষ্টা কেন? উত্তর খুঁজছে পাহাড়। উত্তর খুঁজছে গোটা বাংলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy