Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
নোটবন্দি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

তবে লুম্পেন পুঁজি বিপাকে পড়েছে

আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: বাতিল নোট-কাণ্ডে এখন সারা দেশ উত্তাল। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই শাসক ও বিরোধীদের রাজনৈতিক তরজাও সমানে চলেছে। কিন্তু এই বিতর্ক এতটাই বন্ধ্যা যে, কে যে কী বলতে চান, তা বোঝা দায়। লিখছেন অসীম চট্টোপাধ্যায়

অসীম চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বাতিল নোট-কাণ্ডে এখন সারা দেশ উত্তাল। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই শাসক ও বিরোধীদের রাজনৈতিক তরজাও সমানে চলেছে। কিন্তু এই বিতর্ক এতটাই বন্ধ্যা যে, কে যে কী বলতে চান, তা বোঝা দায়। শাসকদের মোদ্দা কথা হল, এই পদক্ষেপের ফলে দেশে বিদ্যমান কালো টাকার সমান্তরাল অর্থব্যবস্থাকে মারণ আঘাত হানা হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে কী করে কালো টাকার কব্জা থেকে দেশ উদ্ধার পাবে, তার কোনও যথার্থ ব্যাখ্যা নেই। অন্য দিকে, বিরোধীরা সঙ্গত ভাবেই মানুষজনের দুর্ভোগ ও হেনস্থার প্রশ্ন তুলছেন, কিন্তু বিস্তর তর্জনগর্জন করলেও এর বিপরীতে তাঁরা কী চান, তা বোঝা দায়। শুধু বোঝা যাচ্ছে এই সত্য যে, হাজার কথা বলেও কী ভাবে মূল প্রশ্নে নীরব থাকা যায়, সেই শিল্পে আমাদের নেতানেত্রীরা খুবই পোক্ত হয়ে উঠেছেন। উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব ও নতুন নোটের অপ্রতুলতার কারণে মানুষের দুর্ভোগ মোচনের জন্য কি কালো টাকার বিরুদ্ধে এই অভিযান বন্ধ করা হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে মমতাদেবী ছাড়া বাকি বিরোধীরা এই অভিযানের পক্ষেই বলবেন, সমস্বরে জানাবেন যে, তাঁরা শুধু জনসাধারণের ভোগান্তির অবসান চান।

জনসাধারণের ভোগান্তি ও হয়রানির ঘটনা অনস্বীকার্য। ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের ফলে সমগ্র অর্থব্যবস্থার পক্ষাঘাত দেখা দিয়েছে। কার্ড ব্যবহার করেন দেশের মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ, বাকিরা নগদে কেনাবেচা করেন। জনসংখ্যার মাত্র ৫৪ শতাংশের ব্যাংকের খাতা আছে, ব্যাংক ব্যবহার করেন ৩০ শতাংশ লোক। তাই মোদীজির ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এ দেশে লেনদেন থমকে যাওয়া ও মানুষজনের হয়রানি স্বাভাবিক। সে দিক থেকে বিরোধীদের বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু মুশকিল হল, যে জনসাধারণের চিন্তায় বিরোধীরা এত আকুল, তাঁদের সিংহভাগই যত অসুবিধাই হোক, দৃঢ় ভাবে নোট বাতিলের পক্ষে। কারণ, তাঁরা মনে করেন যে, নোট বাতিল করে দেশে কালো টাকার দাপট রোখা যাবে। কিন্তু এ ভাবে কি সত্যই কালো টাকার অর্থব্যবস্থাকে দমন করা যাবে?

তার আগে একটা কথা বলা দরকার। দেশকে কালো টাকা মুক্ত করতে পারুন আর না-ই পারুন, নোট বাতিল কর্মসূচি লুম্পেন পুঁজিকে মারণ-আঘাত হেনেছে। লুম্পেন পুঁজি বলতে বেআইনি অর্থ লগ্নি কারবারের টাকাকেই বোঝায়, অর্থাৎ সারদা-নারদা, ঘুষ, তোলাবাজি ইত্যাদি। সনাতন পুঁজি উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্বৃত্তমূল্য আহরণ করে ক্রমে স্ফীত হয়ে ভার্টিকাল বা উল্লম্ব বৃদ্ধি ঘটায়, লুম্পেন পুঁজির ক্ষেত্রে উৎপাদনের গল্প নেই, প্রতারণা বা জবরদস্তির ক্ষেত্র বাড়িয়ে তা আহৃত হয়। এর বিস্তার হরাইজন্টাল বা অনুভূমিক, মেলা-খেলা-উৎসব-মোচ্ছবেই এর উপযোগ। এদের প্রায় পুরো টাকাটাই থাকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে। নিঃসন্দেহে নোট বাতিলের কর্মসূচি এদের সঞ্চিত পুঁজিকে বাজে কাগজের বস্তা বানিয়ে ছেড়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই এই পুঁজির রক্ষকরা চিল-চিৎকার জুড়েছে ও যেন তেন প্রকারেণ এই কর্মসূচি গুটিয়ে ফেলার বা অন্তত স্থগিত রাখার আওয়াজ তুলেছে। নিঃসন্দেহে এখানে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ লক্ষ্যভেদে সফল। কিন্তু এখানেও মোদীজির ঋণ-কাঁটা আছে: তথাকথিত চিটফান্ড প্রতারকদের টাকা বাজে কাগজ হয়ে যাওয়ার পর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নৈতিক দায় মোদী সরকারের ওপরেই বর্তায়। এটা কোনও ছোট ব্যাপার নয়। ৯০ লক্ষাধিক আমানতকারীর সঙ্গে তাঁদের পরিবার অর্থাৎ (গড়ে ৫ জন ধরলে) প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের ভাগ্য এর সঙ্গে জড়িত, জড়িত ১৩৮ জন আত্মঘাতী আমানতকারীর পরিবারের ভাগ্যও।

কিন্তু লুম্পেন পুঁজিকে মারণ আঘাত হানলেও, আসল লক্ষ্য যে কালো টাকার অর্থ-ব্যবস্থা, সেখানে নোট বাতিলের কর্মসূচি কোনও আঁচড় কাটতে পারবে না। কারণ, কালো টাকার একটা বড় অংশ রয়েছে বিদেশি ব্যাংকে এবং সোনা-হিরে-জহরতে, তার পর সিংহভাগ খাটছে শেয়ার মার্কেট ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। নগদে রয়েছে মোট টাকার মাত্র ৬ শতাংশ। স্পষ্টতই কালো টাকার কারবারিরা বড় মাপের খেলোয়াড়, মোদীজির এই ছোট জালে বড় জোর মাত্র ৬ শতাংশ ধরা যাবে।

অধুনা বহুচর্চিত এই তথ্য মোদী সরকারের অজানা নয়। তবে নোট বাতিল নিয়ে এত লাফালাফি কেন, কেনই বা অগণিত মানুষের এত হয়রানি? আসলে নোট বাতিল কর্মসূচির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের লক্ষ্য রয়েছে।

রাজনৈতিক লক্ষ্য হল, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের মতোই মোদীজির ভাবমূর্তির নবনির্মাণ। গত আড়াই বছরে মোদীজির ভাবমূর্তির রং চটেছে, আবেদন ভোঁতা হয়েছে, মানুষজনের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এর কারণ, ২০১৪ সালে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলির সিংহভাগই অপূর্ণ রয়ে গেছে। বছরে দুই কোটি চাকরি হয়নি, কালো টাকা বিদেশ থেকে ফেরেনি, ডলারের দাম ৪৫ টাকায় নেমে আসেনি, মূল্যবৃদ্ধি কমানো যায়নি। এই স্বপ্নভঙ্গের ফলে লুপ্ত মোদী-ম্যাজিক ফেরানোর জন্য নোট বাতিল নিয়ে কালো টাকার বিরুদ্ধে এত সিংহগর্জন! বিজেপি ভাবছে যে, এই ফাঁকা আওয়াজের ফাঁক ও ফাঁকি বুঝতে বুঝতেই কাশ্মীর-রোহিত ভেমুলা-মহম্মদ আসলাম ভুলে উত্তরপ্রদেশ-পঞ্জাব বা আগামী বছরে গুজরাত-উত্তরাখণ্ড-মণিপুরে উতরে যাওয়া যাবে। তেমন হলে ২০১৯ উতরে যাওয়াও বিচিত্র নয়!

কিন্তু এর থেকেও আকর্ষণীয় হল অর্থনৈতিক লক্ষ্য। যতই ‘অচ্ছে দিন’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র গল্প শোনানো হোক না কেন, দেশের অর্থব্যবস্থার হাল সঙ্গিন। বড় পুঁজিপতিদের ঋণ-খেলাপির কারণে অনাদায়ী ঋণের ভারে ব্যাংকগুলিতে নগদ টাকার জোগান তলানিতে ঠেকেছে। বার বার অনুদান আর ভর্তুকি দিয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। রাজাদেশ বলে বাতিল টাকা ব্যাংকে জমা পড়লে সংকট কাটে। আবার, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য আরও বেশি সংখ্যক লোককে করের আওতায় আনা প্রয়োজন। এখন শতকরা ২০ জন করদাতা। ব্যাংকে যাঁরা টাকা জমা দিচ্ছেন, তাঁদের একাংশকেও করের আওতায় আনা অন্যতম লক্ষ্য।

আসলে, মোদীজির নোট বাতিলের কর্মসূচি কর্পোরেট পুঁজিকে তুষ্ট করার সঙ্গে সম্পর্কিত। কর্পোরেট পুঁজি চায় ১) ব্যাংকের সুদে হ্রাস, ২) ট্যাক্সের হারে হ্রাস, ৩) জিএস টি-র মাধ্যমে দেশ জুড়ে সুষম কর ব্যবস্থা প্রচলন করা। নোট বাতিল কর্মসূচির দৌলতে ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধি এবং রাজাদেশে আমানত ধরে রাখার সুযোগে ব্যাংকে সুদ হ্রাস সম্ভব হবে। এমনিতে সুদ হ্রাস হলে আমানত কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা না হওয়ায় অনায়াসে সুদ কমানো যাবে। কর্পোরেট পুঁজি ট্যাক্সের ক্ষেত্রে যে সুবিধা চায়, আরও বেশি লোককে করের আওতায় আনার ফলে সেই সুবিধা দেওয়া যাবে। এর সঙ্গে জিএসটি বলবৎ হলেই দেশ জুড়ে সুষম হারে এককালীন ট্যাক্স আদায়ের জন্য কর্পোরেট পুঁজির দীর্ঘদিনের বাসনা অবশেষে পূরণ হতে চলেছে। আবার, বর্তমান অবস্থায় বাধ্য হয়ে যত বেশি মানুষ ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড বা ‘প্লাস্টিক মানি’ ব্যবহার করবেন এবং এর জন্য যত বেশি শপিং মলে যেতে বাধ্য হবেন, ততই তাঁদের বেশি কর দিতে হবে। তাই বলা যায় যে, নোট বাতিলের কর্মসূচি আসলে কর্পোরেট পুঁজিরই এজেন্ডা, যা রূপায়ণের দায়িত্ব মোদী সরকার নিয়েছে। এখানে জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদির কোনও যোগ নেই, এমনকী কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদের ভূমিকাও প্রান্তিক। বিরোধী দলগুলি এ সব কথা মানুষজনের সামনে কেন তুলে ধরছেন না, আমার জানা নেই।

গভীর বেদনা নিয়ে ভাবছি সেই মানুষদের কথা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যাঁরা ভাবছেন, দেশের জন্য ত্যাগস্বীকার করছেন! লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যেক ‘উপেন’-কে কর্পোরেট পুঁজি তর্জনী উঁচিয়ে বলছে, ‘বুঝেছ উপেন, এ টাকা লইব ছিনে।’ আমাদের চোখের সামনে ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ আমি শুধু ভাবি, আইনের কোন ধারা মোতাবেক আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি না করে, কোনও সরকার আমার জমা টাকার ওপর এমন ‘এমবার্গো’ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE