Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কানা মামা

আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, সিদ্ধা ও হোমিয়োপ্যাথি, (সংক্ষেপে ‘আয়ুষ’) এই পাঁচটি বিকল্প চিকিৎসা সরকারি স্বীকৃতি পাইয়াছে। এই সকল ধারায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা কী করিতে পারিবেন, তাহা তাঁহাদের নিজস্ব বিজ্ঞানেই বলা হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ভি জা খড়ে অগ্নিসংযোগ করিলে ধূম অধিক হয়। বিকল্প চিকিৎসা লইয়া গোলযোগের উৎসেও বিজ্ঞানের আলো নাই, আছে অবিবেচক স্বার্থচিন্তা। আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, সিদ্ধা ও হোমিয়োপ্যাথি, (সংক্ষেপে ‘আয়ুষ’) এই পাঁচটি বিকল্প চিকিৎসা সরকারি স্বীকৃতি পাইয়াছে। এই সকল ধারায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা কী করিতে পারিবেন, তাহা তাঁহাদের নিজস্ব বিজ্ঞানেই বলা হইয়াছে। কী পারিবেন না, তাহা মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া আইনে স্পষ্ট করা রহিয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট (১৯৯৬) ও দিল্লি হাই কোর্টও (২০১৬) স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে, হোমিয়োপ্যাথি বা ভারতীয় ধারার চিকিৎসায় প্রশিক্ষিতরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঔষধ লিখিতে পারিবেন না। তাহা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে, ছিদ্রপথে শনি প্রবেশের মতো, সরকার-সৃষ্ট নিয়মে কিছু ফাঁকের সুযোগ লইতেছেন এক শ্রেণির ডাক্তার। যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি নির্দিষ্ট কয়েকটি রোগের চিকিৎসায় কী ঔষধ কী পদ্ধতিতে প্রয়োগ হইবে, সেই ‘প্রোটোকল’ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে সরকার স্থির করে। সেই ক্ষেত্রে বিকল্প ধারার চিকিৎসকেরাও সরকার-নির্দিষ্ট আধুনিক চিকিৎসা করিবেন, এই নির্দেশ দিয়াছে কেন্দ্র। ইহার অর্থ অস্পষ্ট নহে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি নির্দেশে বলিয়াছে, কী কী ঔষধ বিকল্প ধারার চিকিৎসক ব্যবহার করিতে পারিবেন না। ইহাকেই অপরাপর আধুনিক ঔষধ ব্যবহারের ছাড়পত্র বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন কিছু ‘আয়ুষ’ ডাক্তার।

এই বিভ্রান্তি কেন? বিজ্ঞান বা আইন, কোনও দৃষ্টিতেই চিকিৎসকের অধীত এবং আয়ত্ত বিদ্যার সীমা অতিক্রম সঙ্গত নহে। শীর্ষ আদালত বলিয়াছে, এক ধারার চিকিৎসক অপর ধারায় চিকিৎসা করিলে তিনি হাতুড়ে বলিয়া পরিগণিত হইবেন, এবং তাহার সমান শাস্তি পাইবেন। বিভিন্ন চিকিৎসাধারার পাঠে কিছু মিল থাকিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু বিবিধ শারীরিক প্রক্রিয়া কী রূপে সম্পন্ন হয়, রোগের উৎপত্তি ও স্বরূপ কী, এবং কী উপায়ে নিরাময় সম্ভব, এ বিষয়ে দর্শন ও প্রয়োগে বহু বৈসাদৃশ্য আছে। তাই ধারাগুলির মিশ্রণ নিষিদ্ধ। জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পে চিকিৎসার ঔষধ বা পদ্ধতি পূর্বনির্দিষ্ট। চিকিৎসকের বিবেচনা সেখানে অনাবশ্যক। আপৎকালীন চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এমন কিছু বিধি বাঁধিয়া দেওয়া সম্ভব। সকল ধারার বিশেষজ্ঞদের লইয়া বসিয়া সর্বসম্মতিক্রমে সেগুলি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

ভুয়ো ডিগ্রির ন্যায় ‘ক্রস-মেডিসিন’ বা ভিন্ন ধারায়, একাধিক ধারায় চিকিৎসাও যে অনৈতিক, তাহা কোনও চিকিৎসকের অবিদিত নাই। কিন্তু ডাক্তারের নামের পশ্চাতে লিখিত ডিগ্রিবাচক ইংরাজি অক্ষরগুলির মর্ম বুঝিবার ক্ষমতা রোগীর নাই। তাঁহার প্রদত্ত ঔষধটি অ্যালোপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ, তাহাও রোগী বোঝে না। বুঝিলেও নাচার, আধা-ভেজাল চিকিৎসকের বিকল্প আগমার্কা হাতুড়ে ডাক্তার। অতএব এম বি বি এস চিকিৎসক অকাতরে আয়ুর্বেদের টনিক, এবং আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ হাসিমুখে অ্যান্টিবায়োটিক লিখিয়া যাইতেছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এমন জগাখিচুড়ি চিকিৎসা চলিতেছে। চিকিৎসার পাঠ, আইনের ধারা, আদালতের রায়, সকলই হার মানিয়াছে অর্থের যুক্তির কাছে। সরকারও চক্ষু বুজিয়াছে, কারণ শূন্যপদ পূরণ করিবার মতো চিকিৎসক নাই। বিভ্রান্তির ধোঁয়া সত্য নহে, লজ্জা ঢাকিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

medicines medical science Doctors Wrong Treatment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE