কমলাকান্ত চক্রবর্তী হয়তো বলিতেন, ভারতের জনজীবন হইতে শিষ্টতা কোথায় গেল? কে লইল? যেখানে থাকিবার কথা, সেখানে নাই কেন? কমলাকান্ত হয়তো টেলিভিশনের সান্ধ্য বৈঠক হইতে সংসদ ভবনের ঐতিহ্যবাহী কক্ষ, সর্বত্র খুঁজিয়া ফিরিয়া শিষ্টতার দর্শন না পাইবার পর সুপ্রিম কোর্টের দরজায় দাঁড়াইতেন। মনে আশা, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদালতে অন্তত শিষ্টতার অভাব হইবে না। হায়! সেই দরজায় দাঁড়াইয়াই কমলাকান্ত শুনিতে পাইতেন, প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের তিরস্কার করিতেছেন। কারণ, শিষ্টতার অভাব। বিচারপতি দীপক মিশ্র বলিতেছেন, কোনও কোনও প্রবীণ আইনজীবী (আদালতে যাঁহারা ‘সিনিয়র’ কাউন্সেল হিসাবে পরিচিত) গলার জোরে আইনি তর্ক জিতিবার চেষ্টা করিতেছেন। আদালত এই প্রবণতাটি সহ্য করিবে না। কমলাকান্ত আরও শুনিতেন, বিচারপতি মিশ্র স্মরণ করাইয়া দিতেছেন, গলা চড়াইয়া জিতিবার চেষ্টা আসলে যোগ্যতা এবং দক্ষতার অভাবই স্পষ্ট করিয়া দেয়। শীর্ষ আদালতের অভিজ্ঞতম আইনজীবীদেরও শিষ্টতার এই প্রাথমিক পাঠটি স্মরণ করাইয়া দিতে হয়, দেখিয়া কমলাকান্ত সম্ভবত ভাবিতেন, ছাতি চাপড়াইয়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিবার রোগটি এমন সর্বজনীন হইল কী ভাবে?
শিষ্টতা বস্তুটি যে মনুষ্যের মৌলিক প্রবৃত্তি নহে, কমলাকান্ত বিলক্ষণ জানেন। সারমেয় অথবা মার্জারকুলে ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসির চল নাই, তাহা প্রসন্ন গোয়ালিনির দিব্য গালিয়া বলা চলে। পাশবিক প্রবৃত্তি অতিক্রম করিয়া নিজেকে একটি বিধির মধ্যে বাঁধিতে শিখিবার নামই সভ্যতা। কয়েক সহস্রাব্দের চেষ্টায় মানুষ শিষ্টতার পাঠটি শিখিয়াছিল। কোনও সভায় কী ভাবে কথা বলিতে হয়, কখন চুপ করিয়া থাকিতে হয়, মানুষ ক্রমে তাহার রীতি শিখিয়াছে। তাহা ক্রমে নানা ভাবে নথিবদ্ধও হইয়াছে। দেশের শীর্ষ আদালতের অভিজ্ঞতম আইনজীবীরা সেই নিয়ম নিশ্চয়ই জানেন। তাঁহারা জানেন, কিন্তু মানেন না। কারণ, গত কয়েক বৎসরে ভারতীয় সমাজ অশিষ্টতাকেই মান্যতা দিয়াছে, বৈধ হিসাবে মানিয়াছে। বহু সহস্রাব্দের সাধনায় যাহা রপ্ত হইয়াছিল, ভারত তাহা কয়েক বৎসরে ভুলিয়াছে। অতঃপর, সভামধ্যে হাতাহাতি হইলেও বিস্ময়ের অবকাশ থাকিবে না।
প্রশ্নটি বৃহত্তর সমাজেরই। যে আচরণ সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নহে, মানুষ সচরাচর তাহাতে বিরত থাকে। আর, সমাজ যাহাতে আপত্তি করে না, মানুষ নির্দ্বিধায় সেই পথে হাঁটে। ভারতের সমাজ ভদ্রতাকে দুর্বলতা বলিয়া মানিয়া লইয়াছে। বিরুদ্ধ মত শুনিবার অভ্যাসটিকে ভাবিয়াছে পরাজয়। মার্কিন গীতিকার পল সাইমন লিখিয়াছিলেন, মানুষ এখন কথা না শুনিয়া কথা বলে, কথা শোনেও কথা না শুনিয়াই। কবি সত্যদ্রষ্টা। এই অভ্যাসে যাহা হারাইয়া গিয়াছে, তাহা হইল কথার অর্থ। কথা আর সংযোগের মাধ্যম নাই, যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত হইয়াছে। যুক্তি দিয়া প্রতিপক্ষকে জিতিবার অভ্যাসটি গিয়া গলার জোরে তাহাকে হারাইয়া দেওয়ার সর্বগ্রাসী প্রবণতা আসিয়াছে। বিতর্কসভায়, সংসদীয় রাজনীতিতে, আদালতেও। কমলাকান্ত চক্রবর্তী হয়তো ভাবিতে বসিবেন, মনুষ্যের সহিত মনুষ্যেতর জীবের ফারাক অতঃপর থাকিবে কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy