Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভরসার মুখ

এই ভয়ংকর সুপ্রোথিত স্বার্থব্যবস্থাকে যদি এক বিন্দুও বিচলিত করিতে হয়, তবে ঠিক এই আন্দোলনটিই জরুরি ছিল।

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৮ ০০:১৩
Share: Save:

চোখে অসহায় অশ্রু, মুখে কঠিন ভাষা— এমন প্রতিবাদীরা যখন হাজারে-হাজারে রাস্তায় বাহির হইয়া আসেন, যে-কোনও শাসকেরই নড়িয়া বসিবার কথা। তদুপরি যদি সেই প্রতিবাদীদের অধিকাংশই জীবনে প্রথম বার প্রতিবাদের আবেগ অনুভব করিয়া বাহির হইয়া আসিয়া থাকেন, তবে তো কথাই নাই। তদুপরি সেই প্রতিবাদীদের মধ্যে যদি প্রথমত ও প্রধানত দেখা যায় দেশের অল্পবয়সি ছাত্রছাত্রীদের, এমনকী জুনিয়র স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও, তবে শাসক পক্ষের তাহা মোটেই ভাল লাগিবার কথা নয়। তবে এ-সকলই নেহাত অনুমান মাত্র। সভ্যতার ইতিহাসে শাসককুল যেহেতু খুব বেশি বার এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন নাই, এমত অনুমানের ভিত্তি খুবই দুর্বল। এ বার ওয়াশিংটন হইতে শুরু করিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস কিংবা ফ্লরিডার পার্কল্যান্ড পর্যন্ত গোটা মার্কিন দেশ জুড়িয়া যে কাণ্ড দেখা গেল, তাহা আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব। নিজেদের জীবনের অধিকারের জন্য এই প্রতিবাদ মিছিলের প্রতিটি মুখ একই দিকে তাকাইয়া আছে, একই দাবি উচ্চারণ করিতেছে, এবং সঙ্গে এমন কথাও বলিতেছে যে আবারও এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হইলে তাঁহাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ভাবিতে হইবে, কিন্তু দাবিটি তাঁহারা ছাড়িবেন না। ভাবিতে ইচ্ছা করে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউসে তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গরা এ-সব দেখিয়া শুনিয়া বিপন্ন বোধ করিতেছেন। কয়েক সহস্র তরুণ কিশোর শিশু কণ্ঠে ‘আর নয়’ শুনিয়া, হোয়াইট হাউসের সামনে কাতারে-কাতারে শয়ান ছেলেমেয়েদের মুখে ‘আমিই কি তবে পরবর্তী লক্ষ্য’ শুনিয়া ভিতরে-ভিতরে বিচলিত হইয়া পড়িতেছেন। অনুমান করিতে ইচ্ছা করে যে, সহজে ও সুলভে বন্দুক ক্রয় বিষয়ে প্রেসিডেন্টের অফিস ও কংগ্রেসের আইন-প্রণয়নকারীবর্গ সকলেই নূতন ভাবে ভাবিতে চলিয়াছেন।

অথচ সকলেই জানেন, অনুমান বস্তুটির মধ্যে পরতে-পরতে মিশিয়া ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষা। তাই হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেসে বন্দুক-লবির ধ্বজাধারীরা মুখে এই ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিলেও এখনও অবধি কোনও সদর্থক বার্তা দেন নাই। কোনও প্রতিক্রিয়া জানান নাই। কারণটি সহজ। রাজনৈতিক স্বার্থ ও জাতীয় বন্দুক সংগঠনের স্বার্থ এমন অঙ্গাঙ্গি জড়াইয়া যে দ্বিতীয়ের অর্থসাহায্যের উপর প্রথমের অস্তিত্ব ও উদ্ভাস নির্ভর করে। সহজে সিদ্ধান্তে আসিবার স্বাধীনতা রাজনীতিকদের নাই। বন্দুকের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক নৈতিক ও ব্যবহারিক যুক্তি শোনা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন্দুক নিয়ন্ত্রণ কেন করা যায় না, সে-প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ করিতেছে রাজনৈতিক যুক্তিই। নৈতিক ও ব্যবহারিক যুক্তি কেবল সেই রাজনৈতিক যুক্তির বাহ্যিক সজ্জা মাত্র।

এই ভয়ংকর সুপ্রোথিত স্বার্থব্যবস্থাকে যদি এক বিন্দুও বিচলিত করিতে হয়, তবে ঠিক এই আন্দোলনটিই জরুরি ছিল। কিন্তু অবাক হইতে হয়, জরুরি কাজটি সত্যই এই ভাবে করা গেল দেখিয়া। আজকালকার রাজনীতিবিমুখ তরুণ প্রজন্মকে এই ভাবে রাস্তায় টানিয়া আনিতে পারা গেল দেখিয়া। সন্দেহ নাই, বন্দুকের গুলির ভয়ই তাহাদের বাহিরে আসিবার প্রধান কারণ, কিন্তু ইহাও সত্য যে, শেষ পর্যন্ত বন্দুকের সূত্রে দেশের প্রবল পরাক্রান্ত রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার চোখে চোখ রাখিয়া প্রতিস্পর্ধার স্বরটি তুলিতে পারিল এই তরুণরাই। কম কথা নয়। মার্কিন দেশে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় অধ্যায়গুলি অবিস্মরণীয়। রাজনৈতিক নেতৃকুলের টনক নাড়াইয়া তাঁহাদের পথ পরিবর্তনে বাধ্য করিতে পারিয়াছিলেন মধ্য-১৯৬০-এর ছাত্রপ্রজন্ম। অর্ধশতক পর আবার কি তারুণ্যের সেই দীপ্ত সাহস ক্ষমতাবলয়ের নির্বিকার স্বার্থান্ধতাকে বড় ধাক্কা দিতে পারিবে? মার্কিন সমাজকে দেখিয়া কেন যেন ভরসায় বুক বাঁধিতে ইচ্ছা করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

youth US India Donald Trump Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE