ভারতের সাংবিধানিক ও আইনি ইতিহাসের মনোযোগী পাঠকমাত্রেরই চোখে পড়বে, সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানকে কী ভাবে দেখছে, এবং সেই দেখা কী ভাবে বদলাচ্ছে, তার কয়েকটা সুস্পষ্ট যুগ রয়েছে। গত শতকের পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্ট মূলত রক্ষণশীল অবস্থান নিত। রাষ্ট্রের তরফে খুব ভুল কোনও সিদ্ধান্ত না হলে নেহরু যুগের কল্যাণ রাষ্ট্রের সঙ্গে আদালত সহমতই হত। সত্তরের দশকে এসে এই ধারায় বিপুল পরিবর্তন হল। সংবিধানের আদর্শ এবং সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আদালত অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে আরম্ভ করল। কেশবানন্দ ভারতী বা মানেকা গাঁধী মামলার মতো বহু উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে আদালতের রায়ে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব এবং সেই সংবিধান যাদের তরফে রচিত, সেই সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা শোনা গিয়েছে।
তার পর থেকেই সাধারণ মানুষের চোখে সুপ্রিম কোর্টের একটি বিশেষ গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। ক্ষমতা আর রাজনীতির ঘোলা জলে মানুষের ন্যায়ের, ন্যায্যতার শেষ ভরসা হিসেবে পরিচিত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সত্যি কথা বলতে, আদালত যে সাংবিধানিক মূল্যবোধের রক্ষাকর্তা হিসেবে সব সময় সমান ভাবে সফল হয়েছে, তেমন দাবি করা মুশকিল। কিন্তু, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে, বিশেষত যখন আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসক একনায়ক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন, তখন। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের চার প্রবীণ বিচারপতির বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে কারও কারও মনে হয়তো আদালত সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কিন্তু, কোনও ব্যক্তিবিশেষের ভুলে প্রতিষ্ঠানের এই দীর্ঘ ইতিহাসকে অস্বীকার করা বিচক্ষণতার কাজ হবে না।
আদালতের ইতিহাসে আরও একটা উল্লেখযোগ্য বছর ছিল ২০১৭ সাল। ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকার আর তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিষয়ে দুটি বিপুল তাৎপর্যপূর্ণ রায় দিয়েছে আদালত। বলা ভাল, প্রথম রায়টির ক্ষেত্রে আদালত পুরনো কিছু রায়ের ওপর জমে থাকা ঝুল সাফ করল, এবং গত চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আইনের যে বাস্তববাদী অবস্থানটি কার্যত সর্বজনস্বীকৃত, তাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল। তাৎক্ষণিক তিন তালাক মামলায় পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ মতৈক্যে পৌঁছতে পারেনি। এমনকী, যে তিন বিচারপতি সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও দ্বিমত ছিল যে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অসাংবিধানিক বলা চলে, না কি শুধু কোরানের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী বলা ঠিক হবে। কিন্তু, এই রায়টিও ভারতের বিচারবিভাগের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই রায়ের ফলে মুসলমান মহিলারা মর্যাদা ও সাম্যের জীবনের অধিকার পেলেন। এই অধিকার রক্ষায় আদালতের অবস্থান নির্দ্বিধ।
এই রায়গুলির গভীরে গিয়ে ভাবলে চিন্তার একটা দার্শনিক সূত্র পাওয়া সম্ভব। সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচারে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে রায়গুলি নিশ্চয় নতুন রাস্তা খুলেছে। কিন্তু, আরও জরুরি এটা খেয়াল করা যে রায়গুলির কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিমানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন। যথেষ্ট যুক্তি থাকলে রাষ্ট্রের পক্ষে নাগরিকের যে কোনও মৌলিক অধিকারই খর্ব করা সম্ভব। ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকারও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু, যখন রাষ্ট্রের নজরদারি সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে (কখনও এমনকী কল্যাণরাষ্ট্রের মোড়কেও), তখন সুপ্রিম কোর্টের ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তার অধিকারের পক্ষে এই রায় বলে দিল, রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্য যে সাধারণ নাগরিকের নেই, তাঁরও আশা আছে— তার জন্য সংবিধানের প্রহরী অতন্দ্র রয়েছে।
তাৎক্ষণিক তিন তালাকের ক্ষেত্রেও একই ছবি। সেই রায় থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রবণতা যদিও সর্বাত্মক, তবুও খেয়াল করা ভাল, সেই রায়ের ক্ষেত্রেও কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মূল অবস্থানটি ছিল অসহায় মুসলমান মহিলাদের অধিকার নিশ্চিত করা। পার্সোনাল ল’র অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে ভারতীয় বিচারবিভাগ মৌলিক অধিকার-ভিত্তিক বিচারের পথে হাঁটে না— সেটাই দীর্ঘ দিনের দস্তুর। বর্তমান মামলায় বিচারপতি নরিম্যান ও বিচারপতি ললিত খানিক ঘুরপথে হলেও ১৯৩৭ সালের মুসলিম পার্সোনাল ল’ (শরিয়ত অ্যাপ্লিকেশন) বিধি, যার ফলে তাৎক্ষণিক তালাকসহ সব ধরনের তালাক (এবং, অন্যান্য শরিয়তি প্রকরণ) এক রকম আইনি স্বীকৃতি পায়, সেই আইনটিকে, এবং তার মাধ্যমে তালাক-উল-বিদ্দত’কে সাংবিধানিক কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করে নিজেদের রায়ে পৌঁছেছেন।
ব্যক্তিমানুষের অধিকার যে আদালতের সিদ্ধান্তের কেন্দ্রস্থলে ছিল, আরও অনেক মামলার রায়ে তার নিদর্শন পাওয়া যাবে। কিছু মামলায় আদালত এমনকী আইনের লিখিত ভাষ্যের সীমা অতিক্রম করে ব্যক্তির সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করেছে। দুটি মামলার কথা উল্লেখ করি। প্রথমটি ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনের ১৩বি ধারা সংক্রান্ত মামলা। এই ধারা অনুযায়ী, পারস্পরিক সম্মতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদ হলেও মামলা দায়ের হওয়ার পর ছয় মাস বাধ্যতামূলক ভাবে অপেক্ষা করতে হত। সুপ্রিম কোর্ট জানাল, কোনও মামলায় যদি উপযুক্ত কারণ থাকে, তবে আদালত এই ছয় মাস সময়টিকে বাধ্যতামূলক গণ্য না-ও করতে পারে। দ্বিতীয় মামলাটিতে আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির সঙ্গে প্রটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট (পকসো), ২০১২-র সাযুজ্য তৈরি করে জানাল, অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনও ধর্ষণ হিসাবেই বিবেচিত হবে। এই রায়টির গুরুত্ব অসীম, কারণ ভারতের আইন বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে না।
ভারতের শাসনব্যবস্থা যে ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের অনুসারী, তাতে আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের মধ্যে দায়িত্ব ও অধিকারের সীমারেখা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে নির্দিষ্ট হওয়ার কথা। এই মডেল বলবে, আইনবিভাগের কাজ হল আইন প্রণয়ন করা, শাসনবিভাগের কাজ তা প্রয়োগ করা, এবং নিষ্পক্ষ মীমাংসাকারী হিসাবে বিচারবিভাগের দায়িত্ব শুধু সেই আইনকে যথাযথ ভাবে ব্যাখ্যা করা। কিন্তু, সত্তরের দশক থেকেই দেখা গিয়েছে, যখন সংকট তৈরি হয়, যখন ঘোরতর অন্যায় হতে থাকে, তখন সুপ্রিম কোর্ট ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। এই কারণেই ভারতীয় বিচারবিভাগ দার্শনিক ভাবে নিয়ম-কেন্দ্রিক না হয়ে ন্যায়-কেন্দ্রিক হয়ে উঠতে চেয়েছে, এবং তার ফলেই জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজম বা আদালতের সক্রিয়তা নামক প্রবণতাটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু, যদিও এই প্রবণতাটির অনেক সমালোচনাও হয়েছে, তবুও বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদালত যদি এমন সচেতন ও সক্রিয়া ভূমিকা গ্রহণ না করত, তবে সত্তরের দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরু থেকে জনস্বার্থ মামলা নামক শক্তিশালী হাতিয়ারও তৈরি হত না।
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেই পথেই আরও এক ধাপ হাঁটল, পরবর্তী স্তরে পৌঁছল। প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে প্রশ্ন করে, পুরনো নীতি ও ব্যবস্থাকে নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে ফিরিয়ে এনে সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্ট ভাবে জানাল, ভারতে সংবিধান এবং আইনের বিচারই সর্বোচ্চ সত্য। আর সত্য সাংবিধানিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে থাকা সাধারণ ভারতীয়রা।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস, কলকাতা-য় আইনবিদ্যার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy