Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

যুদ্ধ হলে বিপদ কিন্তু ভারতেরই বেশি

দিল্লির পক্ষে আর একটি উদ্বেগের কারণ হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠনগুলি। চিন-ভারত সংঘাতের সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না। সেই সুযোগ নিয়ে তারা সেখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

পলাশ পাল
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হলে ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের ওপর ভারত তার সামরিক অবস্থান জোরদার করবে। দিল্লি এদের ওপর ভারত চাপ সৃষ্টি করবে, যাতে চিন তাদের কাছ থেকে কোনও সুবিধা না পায়। অন্য দিকে, বেজিংও তৎপর হবে, প্রতিবেশী দেশগুলিও যেন কোনও ভাবেই ভারতের তৃতীয় পক্ষ না হয়ে ওঠে। কিন্তু সত্যি সত্যি দিল্লি যদি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে তার তৃতীয় পক্ষ হতে বাধ্য করে, কিংবা সে সব দেশে দিল্লির সামরিক উপস্থিতি ঘটে, তবে এই দেশগুলিতে ভারতবিরোধী রাজনীতি আরও জোরদার হবার সম্ভাবনা রয়েছে। যার সুযোগ নেবে বেজিং। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান বা শ্রীলঙ্কায় যতই ভারতের (সাউথ ব্লকের দাবি অনুযায়ী) ‘বন্ধু সরকার’-এর উপস্থিতি থাক, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই চাপকে উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে।

দিল্লির পক্ষে আর একটি উদ্বেগের কারণ হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠনগুলি। চিন-ভারত সংঘাতের সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না। সেই সুযোগ নিয়ে তারা সেখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ফলে শিলিগুড়ি করিডরকে সুরক্ষিত রাখতে এবং সামগ্রিক ভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারতকে এখানে একসঙ্গে দুটি ফ্রন্টে লড়াই করতে হবে। ইতিপূর্বে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে দমন করতে দিল্লি ভুটান, মায়ানমার, নেপাল ও বাংলাদেশের সাহায্য পেয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হলে এই দেশগুলির উপর ভারত আবার চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু যুদ্ধের সময় এটা যে চিন ভাল ভাবে নেবে না, সেটা তারা জানে। কেননা, তখন সেটা হয়ে যাবে ভারতের হয়ে চিনের বিরুদ্ধে অবস্থান। তাই দিল্লির চাপে তারা কতটা সাড়া দেবে, তা নিয়ে প্রশ্নের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যাচ্ছে।

ভারতের পক্ষে আর একটি দুঃসংবাদ হতে পারে দক্ষিণ চিন সাগর অবরোধ। এই অঞ্চল ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। চিন স্বভাবতই ব্যবসাবাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে দিল্লিকে বিপাকে ফেলতে চাইবে। ইদানীং এ-রকম একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বেজিং রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে কখনও মেশায় না। বাস্তবে কিন্তু এর উল্টোটাই বেশি দেখা গেছে। যেখানে চিনের স্বার্থ বিপন্ন হয়েছে, বেজিং বাণিজ্যকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া চিনের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে, তার প্রতিক্রিয়ায় বেজিং দেশটির উপর ব্যাপক অর্থনেতিক অবরোধ আরোপ করে। একই ঘটনা মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন বা জাপানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। গত বছর দলাই লামা মঙ্গোলিয়া সফর করেছিলেন। বেজিং এই ঘটনায় নিজের উষ্মা প্রকাশের জন্য মঙ্গোলিয়ার পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক জরিমানা আরোপ করে। আবার ২০১২ সালে জাপানের সঙ্গে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ এবং ফিলিপাইনের সঙ্গে দক্ষিণ চিন সাগরে স্কারবরো বালুচর নিয়ে বিবাদের জেরে দেশ দুটির উপর বাণিজ্য-অস্ত্র প্রয়োগ করে চিন। ফিলিপাইনের কলা আমদানি নিষিদ্ধ করার ফলে সে দেশের হাজার হাজার চাষি বিপন্ন হয়ে পড়েন।

এটা সত্যি, চিন এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দিল্লির বিরুদ্ধে এ রকম পদক্ষেপ করেনি। তার একটা কারণ হল, ভারতে চিনের রফতানি আমদানির তুলনায় পাঁচ গুণ। কিন্তু সে এই পথে কখনও হাঁটবে না, এমন ধারণা শিশুসুলভ হবে। চিন যদিও বা নিজে না করে, তার ঘনিষ্ঠদের চাপ দিয়ে এই পদক্ষেপে বাধ্য করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান তখন দিল্লির ডাকে কতটা সাড়া দেবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। কেননা, উত্তর কোরিয়াকে সামলাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন চিনকে।

অন্য দিকে রয়েছে পাকিস্তান। চিন তো নিজেই বলেছে, ভারত যদি তৃতীয় পক্ষ হয়ে ভুটানে সেনা মোতায়েন করতে পারে তবে সে পাকিস্তানের হয়ে কাশ্মীরে অবস্থান করবে। ভারত-চিন সংঘাতের সুযোগ নিতে পাকিস্তানও ছাড়বে না। কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠবে। এই অঞ্চল এমনিতেই এখন অস্থির।

এ তো গেল যুদ্ধকালীন অবস্থা। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হবে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতিতে বড়সড় ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা তো রয়েছে। সেই সঙ্গে, যুদ্ধে যদি ভারত সত্যই পরাজিত হয় (সেই সম্ভাবনাই বেশি), দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চিনের আধিপত্য আরও জোরদার হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির অভিমুখ চিনের দিকে ঘুরে যেতে পারে। এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে।

এক কথায়, চিন-ভারত যুদ্ধের ফলে ভারতের দেহে ‘স্পেনীয় ক্যান্সার’-এর মতো গভীর ক্ষত তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এবং, স্পেনীয় ক্যান্সার নেপোলিয়নের পতনকে তরান্বিত করেছিল, কিন্তু চিন-ভারত যুদ্ধ শুধু নরেন্দ্র মোদীর মর্যাদাহানিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা দুনিয়ায় ভারতের মর্যাদা ভূ-লুণ্ঠিত হবে।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE