প্রায় এক সহস্র চিত্রনাট্য লইয়া আমেরিকায় এক সমীক্ষায় দেখা যাইল, চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রের মূল্য পুরুষ চরিত্রের তুলনায় অত্যন্ত ন্যূন। এবং, বহু সময় নারী চরিত্রকে সম্পূর্ণ সরাইয়া লইলেও মূল গল্পের প্রবল হেরফের ঘটে না। পুরুষ চরিত্রেরা অধিকাংশ সময় কথা বলে তাহাদের কীর্তি লইয়া, নারী চরিত্রেরা বলে পারিবারিক মূল্যবোধ লইয়া। পুরুষের সংলাপ পরিমাণেও অধিক। ছবিতে পুরুষ চরিত্রের সংখ্যাও অধিক। প্রতিটি দ্যোতকই একই দিকে নির্দেশ করে: চলচ্চিত্রে নারীকে প্রদর্শন করা হইয়াছে মূলত পুরুষের সাপেক্ষে, স্বতন্ত্র চরিত্র হিসাবে নহে। এই মূহূর্তে হলিউডের বহু নায়িকা তাঁহাদের সহিত নায়কদের পারিশ্রমিকের প্রকাণ্ড পার্থক্য লইয়া সরব হইতেছেন, এমন সময় সার্বিক ভাবে চলচ্চিত্রে নারীর স্থান লইয়া এমন সমীক্ষা সমানাধিকারের কাজে লাগিবার সম্ভাবনা।
সমগ্র সমাজেই যখন পুরুষের প্রাধান্য এবং তাহা বজায় রাখিবার প্রয়াস বিলক্ষণ চলিতেছে, তখন চলচ্চিত্র তাহা হইতে মুক্ত থাকিবে, কল্পনা করাই বাতুলতা। বিশেষত যখন চলচ্চিত্র আধুনিক মানুষের মনোভঙ্গি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান, এবং শিল্পটিও পুরুষ-অধ্যুষিত। নারী পরিচালক বা চিত্রনাট্যকারের সংখ্যা নিতান্ত গৌণ। যুগ যুগ ধরিয়াই তো এমন ছবিই নির্মিত হইতেছে, যে কাহিনিতে এক পুরুষ বহু প্রতিকূলতার সহিত লড়িয়া জয় লাভ করিবে, আর এক নারী তাহার ক্ষতস্থানে মলম লাগাইবে, তাহাকে ভালবাসিয়া কাঁদিবে হাসিবে। ইদানীং ছক ভাঙিয়া নারীকেন্দ্রিক ছবি অবশ্যই তৈয়ারি হইতেছে, কিন্তু তাহা সংখ্যায় অধিক নহে, কারণ নৈতিক যাথাযথ্যের দায় লইয়া বাণিজ্য মাথা ঘামাইবে না। তবে, সমীক্ষাটি দেখাইয়াছে, চিত্রনাট্য লইয়া আলোচনার সময় এক বা একাধিক মহিলা উপস্থিত থাকিলে, নারী চরিত্রের পরদায় প্রতিভাত হইবার মুহূর্ত প্রায় ৫০% বৃদ্ধি পায়। হয়তো ছবিতে নারী ও পুরুষের সমবণ্টনের একটি উপায় হইল রচনার প্রক্রিয়ায় নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা।
তবে, ভারতে নারী পরিচালক বা নারী চিত্রনাট্যকারের সংখ্যা গুনিলে, বা ভারতীয় ছবিতে নারীর চরিত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করিলে, সমীক্ষকরা হয়তো মূর্ছা যাইতেন। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, ভারতীয় ছবিতে নারী নিছক প্রণয়পুত্তলি, তাহাকে আয়ত্ত করিবার প্রচলিত পদ্ধতি তাহাকে নিরন্তর উত্ত্যক্ত করিয়া প্রেম নিবেদন। নায়িকার কাজ নৃত্য-গীত পরিবেশন, যৌন আবেদন বিকিরণ, রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচার এবং নতমুখে নায়কের অনুসরণ। এমন সংগীতও রচিত হইয়াছে ভারতীয় চলচ্চিত্রে, যাহা বলিয়াছে, স্বামী ভাল বা মন্দ যাহাই হউন না কেন, তিনি আমার দেবতা। প্রাচীন ভারতীয় ছবিতে এক প্রবল ভিলেন: পাশ্চাত্য মূল্যবোধ। যে নারী পাশ্চাত্য পোশাক পরিতে ভালবাসে, পার্টিতে যাইয়া পাশ্চাত্য সংগীতের সহিত নৃত্য করে, সে খলনায়িকা। ইদানীং অবশ্য নায়িকা ও ভ্যাম্পের তফাত ঘুচিয়াছে, নায়িকা প্রয়োজনে বিকিনি ও প্রয়োজনে ঘোমটা ব্যবহার করিতেছে, তবু মূল প্রবণতা আদৌ পালটায় নাই, ছবির কাহিনিতে নারী অলংকারের অধিক কিছুই নহে। সে সারবতী নহে, কেবলই পটে লিখা, এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সেই পট পরিবর্তনের আশু সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy