অর্জুন পণ করিয়াছিলেন, সূর্যাস্তের পূর্বেই জয়দ্রথকে বধ করিবেন। মহাকাব্যিক পণ, নড়চ়ড় হইবার উপায় নাই। জয়দ্রথও আত্মগোপন করিয়া ছিলেন। অতএব, কৃষ্ণ তাঁহার সুদর্শন চক্রে সূর্যকে ঢাকিয়া দিলেন। দিন ফুরাইয়াছে ভাবিয়া জয়দ্রথও বাহিরে আসিলেন, অর্জুন তাঁহাকে বধ করিয়া পণরক্ষা করিলেন। কৌশলই বটে। কিন্তু, জেদের চোটে যাহাতে যুদ্ধ হাতছাড়া না হইয়া যায়, তাহার জন্য কৌশলের শরণাপন্ন হইতে হয়। পশ্চিমবঙ্গেও যেমন ‘ফ্রি-হোল্ড’ আসিয়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সূর্যকে ঢাকিল। মুখ্যমন্ত্রীরও জেদরক্ষা হইল, ইনফোসিস-এর বিনিয়োগের পথে বাধাও কাটিল। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাটির সহিত রাজ্য সরকারের কী চুক্তি হইয়াছে, সংস্থাকে কতখানি সুবিধা করিয়া দেওয়া হইল, এই প্রশ্নগুলি গৌণ। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ইহা এক সন্ধিক্ষণ। প্রকৃত শিল্পবান্ধব হইয়া উঠিতে এখনও বহু পথ চলা বাকি। কিন্তু, প্রথম পদক্ষেপটি সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বীকৃতি ভিন্নও যে লগ্নিকারীদের আশ্বস্ত করিবার পথ আছে, তাহা খুঁজিয়া পাওয়া রাজ্য সরকারের কৃতিত্বই বটে। কারণ, ছয় বৎসরে স্পষ্ট হইয়াছে, বৃহৎ পুঁজির বিকল্প নাই। তেলেভাজা বা মিষ্টি হাব লইয়া ঠিক কত দূর যাওয়া সম্ভব, তাহা বোঝা গিয়াছে।
একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাকে ২৫ একর জমি তাহাদের ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করিতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত— নেহাত বস্তুগত মাপে— ছোটই। ইনফোসিস যত টাকা লগ্নি করিবে, এবং তাহাতে যত কর্মসংস্থান হইবে, গোটা রাজ্যের প্রেক্ষিতে তাহাও বিপুল নহে। কিন্তু, এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অন্যত্র। রাজ্যের স্বার্থেই রাজ্য সরকারকে নমনীয় হইতে হইবে, মুখ্যমন্ত্রী এই কথাটি মানিতে দীর্ঘ দিন গররাজি ছিলেন। তাঁহার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু রাজ্যের স্বার্থকে যে দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়াই বিধেয়, প্রশাসকের এই প্রাথমিক পাঠটি মুখ্যমন্ত্রী এ যাবৎ অস্বীকার করিয়াছেন। সিঙ্গুর হইতে শালবনি, রাজ্যের হরেক প্রান্তে তাহার কুপ্রভাব প়ড়িয়াছে। রাজ্যবাসী আশা করিতে পারেন, সেই জেদ, সেই অনমনীয়তা, অতঃপর অতীত হইল। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে যাহা করা প্রয়োজন, মুখ্যমন্ত্রী করিবেন।
শিল্পপতিরা রাজ্যের নিকট আর্থিক সুবিধা প্রত্যাশা করেন, প্রশাসনিক সহযোগিতা দাবি করেন। তাঁহাদের সব দাবিই পূরণ করিতে হইবে, অথবা সব প্রত্যাশা মিটাইতে হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা রাজ্য সরকারের নাই। নিজেদের মূলগত বিশ্বাসে অনড় থাকিবার অধিকার সব সরকারের আছে। শিল্পমহলও কথাটি বিলক্ষণ জানে। রাজ্য সরকার জমি জোগাড় করিয়া দিলে তাহাদের লাভ, কিন্তু না দিলে জমি তাহারা খুঁজিয়া লইতে পারে। শিল্পমহলের মূল দাবি এই গোত্রের সুযোগসুবিধার নহে। তাহাদের প্রধান প্রয়োজন বিশ্বাস। রাজ্য সরকার তাহাদের সমস্যা বুঝিতে, এবং তাহার সমাধান করিতে প্রস্তত, এই বিশ্বাস। পশ্চিমবঙ্গে এই বিশ্বাসেরই বিপুল ঘাটতি ছিল। ইনফোসিস বিষয়ক বর্তমান সিদ্ধান্তটি সেই ঘাটতি মিটাইতে অতি তাৎপর্যপূর্ণ হইতে পারে। শিল্পমহল এই সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি ইতিবাচক বার্তা পাঠ করিবে। তবে, এখানেই থামিলে চলিবে না। বিশ্বাসের সম্পর্কটি যাহাতে দৃঢ়তর হয়, রাজ্য সরকারকে তাহার জন্য সচেতন এবং সচেষ্ট হইতে হইবে। এখনও বহু পথ চলা বাকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy