একটু বড় আকারের ঘড়ির মতো গোল করে কাটা কাগজ, তাতে সময়-চিহ্নের বদলে বাংলা বর্ণমালার বর্ণগুলো এলোমেলো ভাবে লেখা। ‘ঘড়ি’-তে কাগজ দিয়েই বানানো দুটো কাঁটা: ছোট কাঁটা লাল আর বড় কাঁটা নীল। কাঁটা দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন বর্ণের ওপর রেখে শব্দ তৈরির প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার কৌশল বোঝাচ্ছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগনার স্বরূপনগরের প্রাথমিক স্কুল-শিক্ষক কমল পাইক। ফেলে দেওয়া কাগজ, স্কেচ পেন আর সামান্য আঠা ব্যবহার করে এই অসামান্য সুন্দর টিএলএম-টি বানিয়েছেন তিনি।
টিএলএম, মানে, টিচিং লার্নিং মেটিরিয়াল। বাংলায় শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ। বিদ্যালয় স্তরে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাদানে যার উপযোগিতার কথা সর্বজনবিদিত। এবং বিস্মিত হওয়ার মতো খবর হল, গত বছর থেকে এই টিএলএম-এর জন্য নির্দিষ্ট ব্যয়বরাদ্দ ছেঁটে দিয়েছে সর্বশিক্ষা-অভিযান। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে রীতিমত ‘বৈপ্লবিক’ পদক্ষেপ বইকী!
তবে এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পড়ানোর সময় শিক্ষা-সহায়ক উপকরণের ব্যবহারে আমাদের রাজ্যের মাস্টারমশাইরা আদৌ অভ্যস্ত নন। এখনও তাঁরা সাবেক কালের রীতি মেনে চেয়ারে বসে ‘লেকচার’ দিয়ে ক্লাস সারতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ম্যাপ, চার্ট, ডায়াগ্রাম ইত্যাদি বাজারে সুলভ এবং প্রায় প্রত্যেক স্কুলেই মজুত থাকা ‘রেডিমেড’ উপকরণগুলোও তাই আলমারির মাথায় পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। এমনকী শিক্ষাদানের প্রশ্নে সবচেয়ে একেবারে অপরিহার্য যে উপকরণ— ব্ল্যাকবোর্ড আর চক-ডাস্টার, তার ব্যবহারও অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষে কতটা হয় (বা আদৌ হয় কি না) সে নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে।
এ ধারায় উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম কমলবাবু অথবা নৈহাটির একটি স্কুলের ভাস্কর সরকারের মতো মাস্টারমশাইরা। হলদিয়ার একটি প্রাইমারি স্কুলে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় তাঁদের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁদের নিজেদের হাতে তৈরি হরেক-রকম রঙবেরঙের আকর্ষণীয় টিএলএম-এর নমুনা দেখা গেল এক ওয়ার্কশপে। আয়োজন করেছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সমীক্ষণ’, সহযোগিতায় ছিল ‘প্রতীচী’। রাজ্যের ৬৩টি প্রাইমারি স্কুল থেকে মোট ১২০ জন শিক্ষকশিক্ষিকা এসেছিলেন। কর্মশালার প্রথমার্ধে তাঁরা নিজেদের তৈরি শিক্ষা-সামগ্রী দেখালেন, দেখলেন, বানানোর কায়দাকানুন শিখলেন। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁরা নিজেরাই বসে বসে রকমারি আকর্ষণীয় টিএলএম বানিয়ে ফেললেন, সযত্নে ব্যাগে পুরে নিয়েও গেলেন সে সব, নিজের নিজের স্কুলে কাজে লাগানোর জন্য। সারা দিন বসে বসে গালভরা বক্তৃতা দেওয়ার আর শোনার যে ‘ওয়ার্কশপ কালচারে’ অভ্যস্ত আমরা, তার থেকে একেবারে অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
কর্মশালায় উপস্থিত মাস্টারমশাইদের মুখেই জানা গেল, মাস দুয়েক আগে প্রতীচীরই উদ্যোগে বীরভূম জেলার সিউড়ি আর বোলপুরে টিএলএম নিয়ে এ রকম পর পর দুটো কর্মশালা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত শিক্ষকশিক্ষিকারাই উৎসাহিত হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বড় আকারে এ রকম ওয়ার্কশপ করার পরিকল্পনা করেন। তারই প্রথম ধাপ পূর্ব-মেদিনীপুরের এই কর্মশালা। ‘ভেনু’ নির্বাচন থেকে শুরু করে গোটা ব্যবস্থাপনাটাই শিক্ষকরা নিজেদের উদ্যোগে করেছেন। দেখেশুনে মনে হল, বাস্তবিক এই মাস্টারমশাই-দিদিমণির দল এক তুমুল হইহল্লা শুরু করেছেন, যা আমাদের রাজ্যের নেতিয়ে পড়া প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থাটাকে চাঙ্গায়নী সুধা দিতে পারে। দিচ্ছেও। কর্মশালায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক জন মাস্টারমশাই জানালেন, ক্রমশই দল ভারী হচ্ছে তাঁদের। বোলপুর বা সিউড়ির থেকে হলদিয়ার এই কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষকশিক্ষিকার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের নেই-ভুবনের হা-হুতাশের মধ্যে কম বড় প্রাপ্তি নয়।
কর্মশালার তারিখটা ছিল ২৬ মার্চ। বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল ম্যাচের দিন। কিন্তু তাতে ওয়ার্কশপের উৎসাহে কোনও খামতি ছিল না।
শহীদ নিত্য দত্ত ফ্রী প্রাইমারী স্কুল-এর (বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা) শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy