Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ষন্ডামার্কা গন্ডগোল

পাঁচ হাজার বছর ধরে একটা জিনিস চলে আসছে, আর জিনিসটা খুব ভাল হচ্ছে— দুটোকে গুলিয়ে ফেলছিস কী করে? সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহরে ত্যাড়াব্যাঁকা আঁকা থাকলেই ঘটনাটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যায়? ধরা যাক একটা গ্রামে বহু যুগ ধরেই প্রতি বুধবার একটা পাগলকে উলঙ্গ করে পেটানো হয়।

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পাঁচ হাজার বছর ধরে একটা জিনিস চলে আসছে, আর জিনিসটা খুব ভাল হচ্ছে— দুটোকে গুলিয়ে ফেলছিস কী করে? সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহরে ত্যাড়াব্যাঁকা আঁকা থাকলেই ঘটনাটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যায়? ধরা যাক একটা গ্রামে বহু যুগ ধরেই প্রতি বুধবার একটা পাগলকে উলঙ্গ করে পেটানো হয়। যে-বুধেই প্রোটেস্ট হবে, লোকে বলবে, অ্যাঁ, পূর্ববর্তী বুধমণ্ডলী মিথ্যে হয়ে গেল! এ উলঙ্গ-ধোলাই দেখে মানুষের যে মজা পাওয়ার অভ্যাস গজিয়েছে, তা কোথায় যাবে? দেখন-ময়দানের চাদ্দিকে যে পাঁপড়-স্টলগুলো লাখ লাখ প্রফিট করে, তারা কোথায় দাঁড়াবে? লোকে এ নিয়ে অ্যাদ্দিন অ্যাত্ত গদ্যপদ্য লিখল, তার কী হবে? উত্তর হচ্ছে, অসভ্যতা থামাতেই হবে। তাতে এগুলো উবে গেলে, যাবে। মজা নাহয় কম পড়বে। পাঁপড় বেচা হবে রথের মেলায়। কাব্য লেখা হবে নয়া নাগরদোলা নিয়ে।

আমাকে টানতে টানতে এনে হাজারে হাজারে লোকের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হবে, তারা চেঁচাবে লাফাবে রইরই করবে হাসবে আমায় ওস্‌কাবে, আর আমি ভয় পেয়ে পাঁইপাঁই দৌড়ব, তখন একটা লোক লাফিয়ে আমার কুঁজ ধরে ঝুলে পড়বে, সে পড়ে গেলে আর এক জন পুনরায় সেই কাণ্ড করবে, ঢিপি করে সবাই আমাকে ঢিট করে পালোয়ানি দেখাবে— এর মধ্যে তোরা সাংঘাতিক বীরত্ব ও পৌরুষের ঝলকানি দেখতে পেতেই পারিস, কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট ঠিকই বলেছে, এতে একটা পেল্লায় নিষ্ঠুরতা নিহিত। হ্যাঁ, আমার চোখে-নাকে লঙ্কার গুঁড়ো ছেটানো হল কি না, ল্যাজ পাশবিক মোচড়ানো হল কি না, লাঠি আর শিক দিয়ে খোঁচানো হল কি না, সে স্ট্যাটিসটিক্সে গুলি মেরেই বলা যায়, এটা নৃশংসতা। ঠিকই, এখানে আমায় মেরে ফেলছিস না। হাড়িকাঠে বলি দেওয়া, বা নির্দিষ্ট পরব মেনে গাদা জন্তু জবাই, অথবা মন্দিরের সামনে শোভাযাত্রা করে পাহাড় থেকে জ্যান্ত ভেড়া ফেলে দিয়ে আশা করা যে এতে অন্য ভেড়ারা সুজলা সুফলা থাকবে— এর সঙ্গে এই ‘জাল্লিকাট্টু’ খেলার ডিগ্রির তফাত আছে। কিন্তু ওই, তফাতটা ডিগ্রির। মূলগত ভাবে ব্যাপারটা একই। প্রথার নামে, কিছু প্রাণীকে অত্যাচার করা। তাদের কী হচ্ছে না হচ্ছে কেয়ার না করে, শুধু নিজের আমোদটায় মনোযোগ দেওয়া। ভেবে নেওয়া, এতগুলো লোক যাতে মজা পাচ্ছে, তার বৈধতা ওই মজাতেই আছে। আর কোনও যুক্তি বা আত্মসমীক্ষার দরকার নেই।

সতীদাহও বহুদ্দিন চলছিল, লোকে মজাও পেত বিস্তর, কিন্তু শয়তান ব্রিটিশরা কিছু ভারতীয় আঁতেলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বন্ধ করে দিল। মহান দেশের গরীয়ান প্রথা, যার মধ্যে ধর্ম ও সংস্কৃতির গুচ্ছ জটিল যুক্তি, তত্ত্ব, সংস্কার, দর্শন জড়াজাপ্টি করে নকশাদার সুজনি বানিয়ে তোদের মাথা থেকে পা অবধি অতিলৌকিক ওম-এ ঢেকে রেখেছে, তা হড়াস করে একটানে সরিয়ে, পাশ্চাত্য মূল্যবোধের ঝাপটা মেরে জাগিয়ে দিলে! কী আস্পদ্দা! কী যাচ্ছেতাই জবরদখল! এক বার ভাবল না, হিন্দু বিবাহিত নারীর অস্তিত্বের অর্থই নেই স্বামী বিহনে— এই সুপ্পার-মাধুর্যমণ্ডিত দাম্পত্য-ধারণার কী হবে? যারা সদ্যবিধবার মরণ-চিৎকার চাপা দেওয়ার জন্যে ঢোল জগঝম্প শিঙে বাজিয়ে বাড়তি রোজগার করে, তাদের কী হবে? ইকনমি ও ফিলজফিকে যুগপৎ ধসিয়ে দিলে গা!

যারা জাল্লিকাট্টু ব্যানের বিরুদ্ধে— তারাও মাল্টিন্যাশনাল চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছে। বলছে, এ খেলা বন্ধ হয়ে গেলে চাষিরা আর ষাঁড় পালবে না, তাইলে জাল্লিকাট্টুতে বিচার হওয়া সেরা ষাঁড় গাঁয়ের গরুদের গর্ভিণী করে তুলবে— সে সিধে-সরল প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হবে, কমে যাবে ভাল দুধ আর লুপ্ত হয়ে যাবে বলদৃপ্ত স্পিশিস। এই দুশ্চিন্তাটা কেন যে ষাঁড়কে জিইয়ে রাখার বিকল্প ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রতি ধাবিত হচ্ছে না, বোঝা দায়। একটা খেলা বন্ধ হয়ে গেলে যদি অর্থনীতি ধসে যায়, তা হলে তো সে অর্থনীতিকে গোঁজ গিয়ে দাঁড় করাবার কথা সিরিয়াসলি ভাবতে হবে, শুধু শিস আর হাততালি দেওয়ার বেপরিশ্রম আহ্লাদগেঁড়ে অ্যাটিটুডে চলবেনেকো।

আগে প্রাণীদের অধিকারের কোনও ধারণাই আম-লোকের ছিল না। মানবাধিকারের ধারণাও না। দলিত, নারী, শিশুর যে আদৌ অধিকার থাকতে পারে, কে ভাবত? কিন্তু এখন তো ভাবার ধরন অন্য। প্রাচীন কালের দোহাই দিয়ে একটা অঙ্ক-না-পারা ছেলেকে ঠা-ঠা রোদে দু’হাতে দুটো থান ইট রেখে শাস্তি দিতে পারিস কি? তা হলে আমায় নিয়ে খেলার সময় প্রাচীন চশমায় এখন-দৃষ্টি অ্যাডজাস্ট করছিস কেন?

না, আমিষ-নিরামিষের প্রশ্ন তুলিসনি। খাওয়ার জন্যে একটা কাজ, আর মজার জন্যে একটা কাজ, আলাদা। ঝামেলা হল, মনুষ্যেতর প্রাণীর অধিকার নিয়ে এই দেশকে কে বোঝাবে? যেখানে লোকে বিনা কারণে আরশোলা মাড়াচ্ছে পিঁপড়ে দলছে কুকুরের ল্যাজে পটকা বাঁধছে বেড়ালকে লাথি মারছে পাখির এক চোখে সরু কাঠি ঢুকিয়ে অন্য চোখ দিয়ে বের করে দিচ্ছে, সেখানে কোন ভাষায় বোঝাব, শ্যামাপোকারও অধিকার আছে, এবং মানুষ এতটা সবল বলেই তার আরও বেশি দায়িত্ব বর্তায় দুর্বলদের সে অধিকারগুলো রক্ষা করার? তার ওপর দগদগ ঐতিহ্যের বিষফোড়া। সকাল সকাল কুকুর দেখলে লাথি মারা আমাদের ঐতিহ্য। ঠাকুদ্দাও মারতেন। লেঃ।

ঐতিহ্যের কথা এত উঠছে যখন, মহাভারতের একটা গল্প বলি। মাণ্ডব্য নামে তপস্বীকে এক রাজা ভুল করে শূলে চড়িয়েছিলেন। মাণ্ডব্য তপস্যার জোরে বেঁচে রইলেন, কিন্তু শূলের একটুখানি তাঁর শরীরে রয়ে গেল। খুব যন্ত্রণা। এক দিন তিনি ধর্মরাজকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সদাচারী তপস্যাব্রতী, কেন এ শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে? ধর্ম বললেন, তুমি শৈশবে একটি পতঙ্গের পিছনে একটা ঘাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলে। এ তারই ফল। এ দেশের মহাকাব্যে এ ভাবেই প্রাণীদের কষ্ট দেওয়ার জন্য দায় বহনের কথা বলা আছে। অবিশ্যি মহাকাব্য পড়ে তো আর ঐতিহ্যের কথা শিখতে হয় না, রকে বসে পিঠ চুলকোতে চুলকোতে আপনা থেকেই তোদের ও-সব পাঠ সেঁধিয়ে যায়। তোদের নোটবুক পড়ে তাই আমি অন্তত জানতে পারব না, পাগলা মানুষ করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাব তায়!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE