কথাগুলো মাঝে মাঝেই শুনতে পাই। এই যখন এক একটা ঘটনাকে ঘিরে আমাদের ঘরের বাচ্চাটাকে গুড টাচ আর ব্যাড টাচ-এর তফাত বোঝাতে বসতে হয়, শিশু নিগ্রহ রোধ আইনের বক্তব্য নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় আর শিশু থেকে যে বালিকা-কিশোরী বা তরুণী হয়ে উঠছে তাকেও ক্রমাগত বোঝাতে হয় অবিশ্বাস ও আত্মরক্ষার কৌশল, কথাগুলো তখনই বেরিয়ে আসে। এই সময় আমরা নিজেদের অজান্তেই এক রকম লিঙ্গবৈষম্যের ভেতরে ঢুকে পড়ি। আমরা কেউ কেউ তখন বলেই ফেলি, ‘আমার কন্যাসন্তান নেই বলে এই দিক থেকে নিশ্চিন্ত, বাব্বা!’
আর ঠিক তখনই ভাবনাটা মাথায় ঘাই মারে, আমরা যারা ঘটনাচক্রে এক্স-ওয়াই ক্রোমোজোমের অধিকারী (পুরুষ) বা তাদের অভিভাবক, তারা কি সত্যিই বিপন্মুক্ত? বোধহয় না। প্রথম কথা হল, যৌন হেনস্তা বা নির্যাতনের শিকার হওয়া যে অর্থে বিপদ, সেই বিপদ থেকে শিশুপুত্ররা আদৌ মুক্ত নয়। আর বিপদ শুধু এই এক রকমেরই নয়। ছোট্টবেলা থেকে নিজের ছোট বোন, পাশের বাড়ির বন্ধু, ইস্কুলের সহপাঠিনীদের সঙ্গে একসঙ্গে বড় হয়ে উঠে আপনার-আমার পরিবারের এক্স-ওয়াই ক্রোমোজোমটি যদি এক দিন হঠাৎ হেনস্তাকারী বা ধর্ষক হয়ে ওঠে, সেটাও ভয়ানক বিপদ। প্রতিটি ধর্ষকই কারও না কারও ছেলে-ভাই-বাবা-স্বামী। তারা সবাই অশিক্ষিত বা অসুস্থ নয়, বরং বেশির ভাগই আপনার-আমার ঘরের ছেলে, যারা কেউই ধর্ষক হয়ে ওঠার মতো কুশিক্ষা পায়নি, অন্তত প্রত্যক্ষ ভাবে। তা হলে কোন মন্ত্রবলে এক দিন সে এই রকম জঘন্য একটা অপরাধ করে ফেলার মানসিকতা অর্জন করল, কী করেই বা তার কোনও এক প্রবৃত্তির কাছে যাবতীয় শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি হেরে গেল, সে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াবার দিন আমাদের সকলের। হ্যাঁ সকলেরই। সমস্ত বাবা
ও মায়ের।
শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত পুরুষদের কথা জেনে, তাদের ছবি দেখে কথাগুলো বার বার ভাবি। অনেকেই ভাল পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছে। অনেকেই রোজ নানা বয়সের শিশুদের সঙ্গেই ওঠাবসা করে, হয়তো কোলেপিঠে নেয় ভাইঝি, ভাগিনেয়ী এমনকী নিজের সন্তানকেও, এক দিন তারাই কেন করে ফেলে এমন গর্হিত অপরাধ? এই প্রবৃত্তির কথা আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। এমনকী নিতান্ত শিশু, যার লিঙ্গপরিচয় গৌণ, তার পীড়নে কী এমন বিশেষ আনন্দ পাওয়া যায়, তা আমাদের বোধের বাইরে। কিন্তু সেটা যখন আমাদের আশেপাশেই ঘটছে, আর ঘনঘনই ঘটছে তখন তাকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং তার গোড়ায় পৌঁছনোর চেষ্টা করা হোক। এই প্রবৃত্তি, যার কাছে আগে-পরের সব সম্ভাবনা ও দুর্ভাবনা তুচ্ছ হয়ে গেল, যে অপরাধ একটি সম্ভাবনাময় তরুণের, এক জন প্রতিষ্ঠিত মানুষের জীবনের সব কিছু বদলে দিল, তাকে এক জন ঘৃণ্য অপরাধীতে পরিণত করল, সেই প্রবৃত্তির শিকার হয়ে পড়াটা কি বিপদ নয়? সেই বিপদ থেকে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদেরই।
এই অবধি পড়ে যাঁরা মনে করছেন এটা অপরাধকে বা অপরাধীকে সমর্থন বা সহানুভূতি দেখাবার চেষ্টা, সবিনয় জানাই তাঁরা ভুল করছেন। প্রতিটি অপরাধী চিহ্নিত হোক এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পাক। কিন্তু শুধুমাত্র অপরাধীর শাস্তিই যেমন আহত শিশুটির শরীর-মন থেকে সব ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারবে না, তেমনই পরবর্তী অপরাধটাও ঠেকাতে পারবে না। যে অপরাধ আপাত-স্পষ্ট কোনও স্বার্থসিদ্ধি করছে না, এক জন আপাত-সাধারণ মানুষ কেন সেই অপরাধ করল বা করে ফেলল, সেটা জেনে নেওয়া আগে দরকার।
তার জন্য প্রথমে দরকার আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। যে কোনও অপরাধীকে চটজলদি ‘মানসিক রোগী’, বিকৃতকাম বা ‘পিডোফিলিক’ বলে দাগিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। আগে বুঝতে হবে ধর্ষণ বা নিপীড়নকে যদি একটা দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা যায়, তবে দু’জনেই দু’ভাবে তার শিকার। আমাদের মেয়েগুলো যাতে আক্রান্ত হয়ে না পড়ে আমরা শুধু সেটা নিয়েই ভাবি; আমাদের ছেলেগুলো যাতে আক্রমণকারী হয়ে পড়ে নিজের জীবনটা নষ্ট না করে ফেলে সেটাও নিশ্চিত করা দরকার। আর সে জন্য এগিয়ে আসতে হবে সমাজবিজ্ঞানীদের, মনোবিজ্ঞানীদেরও। বিভিন্ন অপরাধীর সঙ্গে কথা বলে অপরাধের কারণ খুঁজে বার করতে হবে। আলোচনা করতে হবে খোলাখুলি, যাতে আমাদের ছেলেগুলোও নিজেদের এই বিপদ (বস্তুত, প্রবৃত্তির আক্রমণ) থেকে রক্ষা করতে পারে। দাবিটা অসম্ভব বা অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে কি না জানি না, কিন্তু মনোবিজ্ঞান তো অনেক প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারে, তাই এতটা আশা।
‘প্রিভেন্শন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর’, এই আপ্তবাক্য মাথায় রাখলে বলতেই হবে, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে অপরাধী তৈরি না হওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজ অন্যের ছেলেকে সেরেফ ‘পারভার্ট’ বা ‘পিডোফিলিক’ বলে দায়িত্ব শেষ করতে পারছি, কারণ ঘটনাটা আমার ঘরে ঘটেনি, আর আমি মনে করি ‘আমার ছেলে খারাপ কিছু করতে পারে না, আমি সে শিক্ষা দিইনি’। কিন্তু এই ভাবে চোখ বুজে থাকলে কাল অপরাধীর বাবা-মায়ের কাঠগড়ায় আমাকেও দাঁড়াতে হতে পারে। সে বড় সুখের দিন নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy