Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

রুদ্ধদ্বার

নরেন্দ্র মোদী যে কথাটি বলেন নাই, তাহা এই রূপ: উগ্র জাতীয়তাবাদ যখন রাজনীতির চালিকাশক্তি হইয়া দাঁড়ায়, অর্থনীতি হইতে কাণ্ডজ্ঞানকে এই ভাবেই বিদায় লইতে হয়।

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০৩
Share: Save:

হায়! একদা যে দেশটি বিশ্বায়নের মূল শক্তি হিসাবে পরিচিত ছিল, আজ তাহার দিকেই বাণিজ্যের দরজা জানালা বন্ধ রাখিবার অভিযোগের আঙুল উঠিতেছে। দাভোস-এ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদী ‘প্রোটেকশনিজম’ বা মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিকূল সংরক্ষণের নীতি বিষয়ে যে কথাগুলি বলিয়াছেন, গোটা দুনিয়া তাহাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা হিসাবেই পড়িতেছে। এবং সেই পাঠে ভুল নাই। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সহিত উদার বাণিজ্যের বিরোধ প্রত্যক্ষ। বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে তাঁহার অবস্থানও আশাপ্রদ নহে। উন্নয়নশীল দুনিয়ার প্রতিনিধি রূপে নরেন্দ্র মোদীর উদ্বেগ যথার্থ। উদার বাণিজ্যের পরিসর সংকুচিত হইতে থাকিলে ভারতের ন্যায় দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে তাহার প্রভাব পড়িবে। বিশ্ব অর্থনীতির পক্ষেও তাহা সুসংবাদ নহে। এমনকী, ট্রাম্পের রক্ষণশীলতা মার্কিন অর্থনীতির পক্ষেও ইতিবাচক হইবে না। তবুও, এই পথে না হাঁটিয়া ট্রাম্পের উপায় নাই। কারণ, অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার দৌড়ে তাঁহার দেশ চিনের তুলনায় বহু যোজন পিছাইয়া পড়িয়াছে। অর্থনীতির যুক্তিকে নিজের পথে চলিতে দিলে চাকরিও সেই পথেই ভিনদেশে— শুধু চিনে নহে, ভারতের ন্যায় বহু দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে— চলিয়া যাইবে। ঘরের দুর্বলতা ঢাকিতেই দরজা জানালা বন্ধ করিবার প্রয়োজন পড়ে। কথাটি নেহরু-ইন্দিরা যুগের ভারতের ক্ষেত্রে যেমন সত্য ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার ক্ষেত্রেও ততখানিই সত্য।

নরেন্দ্র মোদী যে কথাটি বলেন নাই, তাহা এই রূপ: উগ্র জাতীয়তাবাদ যখন রাজনীতির চালিকাশক্তি হইয়া দাঁড়ায়, অর্থনীতি হইতে কাণ্ডজ্ঞানকে এই ভাবেই বিদায় লইতে হয়। আমেরিকাকে ফের তাহার পুরাতন গৌরব ফিরাইয়া দেওয়ার যে সংকল্পের কথা ডোনাল্ড ট্রাম্প গালগলা ফুলাইয়া প্রচার করিয়া থাকেন, তাহার এক পিঠে আছে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’, আর অন্য পিঠে এই অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতা। অন্যের তুলনায় উন্নততর হইয়া উঠিবার দুইটিই সহজ পথ— ‘অপর’-কে ছোট করিয়া দেখা এবং প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করিয়া দেওয়া। তবে, এই রোগে যে শুধু আমেরিকাই আক্রান্ত, তাহা বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। গোটা দুনিয়াই ক্রমশ এই উগ্র জাতীয়তাবাদের খপ্পরে পড়িতেছে। দাভোসের মঞ্চে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্র মোদী বলিবেন না— বলিবার প্রয়োজনও নাই— যে, ভারতও একই পথের পথিক। চিনের সহিত প্রতিযোগিতার গল্পটিকে ক্রমাগত জাতীয়তাবাদের ময়দানে টানিয়া আনিবার প্রবণতার ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতা সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী সংশয় প্রকাশ করিয়াছেন। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারই হউক বা বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠন, প্রতিষ্ঠানগুলির কুশলতা বহুলাংশে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাহার মূল কারণ, নিজের মত মানিতে বাধ্য করিবার সামর্থ্য এই প্রতিষ্ঠানগুলির নাই। কোনও দেশ আর্থিক সংকটে পড়িয়া আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হইলে তাহাকে আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটিতে কার্যত বাধ্য করা যায়— ১৯৯১ সালের ভারত তাহার সাক্ষ্য দিবে— কিন্তু, যে দেশ তাহাদের দ্বারস্থ নহে, তাহার মতের বিরুদ্ধে তাহাকে উদার বাণিজ্যের পথে ধরিয়া রাখিবার সাধ্য কোথায়? কাজেই, এক্ষণে প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির। উদার বাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং অনিবার্যতার কথা প্রতিষ্ঠা করিবার। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপ়়ড়েন যাহাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ রুখিতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করিবার। এবং বাণিজ্যের নূতন পথ খুলিবার। ভারতও কি সেই কাজ করিতেছে? নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের দিকে তাকাইয়া না থাকিয়া ‘আন্তর্জাতিক’ হইয়া উঠিবার চেষ্টা কি ভারতেরও আছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Davos Donald Trump Narendra Modi US India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE