Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

যত ভয় ক্যামেরায়

ছ’মাস না ঘুরতে আলিপুর ট্রেজারির সামনে নগ্ন করে মারধর করা হল চিত্র-সাংবাদিককে। নেহাত কলকাতার রাজপথ, তাই ঘটনাটা চাপা রইল না।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫২
Share: Save:

তিনটে গুলি খেয়ে গৌরী লঙ্কেশ লুটিয়ে পড়তে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিল কলকাতা প্রেস ক্লাব। অনেক সাংবাদিক এলেন না। যাঁরা এলেন, তাঁরাও অনেকে ফিরে গেলেন। কারণ, গত সেপ্টেম্বরের সেই মিছিলের সামনে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘সল্ট লেকের ভোটে মমতার পুলিশের হাতে কী মারটাই খেয়েছি। তাঁর মিছিলে হাঁটব?’ তিক্ত হেসেছিলেন এক টিভি-সাংবাদিক।

ছ’মাস না ঘুরতে আলিপুর ট্রেজারির সামনে নগ্ন করে মারধর করা হল চিত্র-সাংবাদিককে। নেহাত কলকাতার রাজপথ, তাই ঘটনাটা চাপা রইল না। জেলাগুলোতে পঞ্চায়েতের মনোনয়নপর্বে কত সাংবাদিক হেনস্থা হয়েছেন, আরও কত জনকে শীতল গলায় বলা হয়েছে, ‘এখানে দাঁড়াবেন না ভাই,’ কে জানে? সরকারি কর্তারাও ফোনে মিঠে গলায় বলছেন, ‘রিলেশন ভাল, তাই বলছি। কাল না বেরোলেই ভাল।’

ভালই হচ্ছে বটে। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের উপর আক্রমণের যত ছবি মিডিয়াতে আসছে, তার একটা বড় অংশ ‘সংগৃহীত’। অর্থাৎ অ-সাংবাদিকের (বিরোধী দল, বা বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর) মোবাইলে তুলে পাঠানো ছবি। সরকার শুধু বিরোধী-বর্জিত ভোট নয়, সাংবাদিক-বর্জিত ভোট চায়। ক্যামেরা বার করলেই সাংবাদিকের হাত ভাঙবে, পায়ের কাছে বোমা ফাটবে। আলিপুরে যা হল, তা গোটা রাজ্যের নেতা-মিডিয়া রাজনৈতিক অঙ্কের লসাগু।

সাংবাদিক সর্বত্রই বিপন্ন। তবু মাত্রার হেরফের। দিল্লিতে গত ২৩ মার্চ এক চিত্র-সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছিল পুলিশ। আর এক মহিলা রিপোর্টারকে যৌন হেনস্থা করেছিল। দু’দিন ক্রমাগত প্রতিবাদ করেন সাংবাদিকরা, শেষে ডেপুটি কমিশনার ক্ষমা চান। এ রাজ্যে?

বিধাননগর পুরভোট (২০১৫), বিধানসভা ভোট (২০১৬), সিপিএম-এর নবান্ন অভিযান (২০১৭) প্রতিটিতে সাংবাদিকের উপর পুলিশ লাঠি চালিয়েছে, ক্যামেরা ভেঙেছে। মাথা ফেটে, হাত ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি সাংবাদিক। একটি পুলিশেরও শাস্তি হয়নি।

প্রকাশ্য মারধর তো চূড়াটুকু। তার নীচে রয়েছে নিত্য হুমকি-হয়রানির কাদা, আর প্রলোভনের পাঁক। রাজনীতি সবাইকে দেনা-পাওনার ছকে আনতে চায়। সাংবাদিকের চিরাচরিত অবস্থান রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধার বাইরে। তাই সামান্য বিক্রীত কাগজের সামান্য শিক্ষিত সাংবাদিক, সামান্য মূল্যের মোবাইল ফোন নিয়ে বাহুবলীর ছক উল্টে দিতে পারে। তাকে ঠেকাতে হবে না?

বাম আমলে হুমকি, পক্ষপাতিত্ব ছিল। কিন্তু তৃণমূল আমলে শুরু হয়েছে সাংবাদিককে হাতে আনার প্রবল, নিরন্তর চাপ। ছকের ভিতরে যে ঢুকবে, তার অপ্রাপ্য কিছু নেই। তার বাইরে থাকলে টিকে থাকাই দুঃসাধ্য। এই নকশাটি সিমেন্টে গাঁথা সৌধের মতো মজবুত করে তোলা হচ্ছে। ওই হল সাংবাদিকতার শহিদবেদি।

তাতে চড়ছে ফুল, বেলপাতা। কেবল দামি উপঢৌকন, খাবারের প্যাকেট নয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বীরভূমের ‘প্রেস কর্নার’ দিয়েছেন দিদি। সিউড়ির জেলা পরিষদ ভবনে সেই ক্লাবের নিজেই উদ্বোধন করেছেন বোলপুর থেকে। আর কলকাতায় ঘোষিত হল সাংবাদিকদের পেনশন। ব্যবস্থাটা বাম আমলে চালু হয়ে থমকে যায়। তৃণমূল সরকার তা নিয়মিত চালু করার ঘোষণা করল ঠিক পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে।

এতে সাংবাদিকের প্রতি তাচ্ছিল্য জাগতে বাধ্য। যারা ছুড়ে-দেওয়া টুকরো কুড়োয়, তাদের কথায় আবার কিসের ভরসা? ঠিক। এবং ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই চায় যে কোনও স্বেচ্ছাচারী সরকার। সংবাদের গ্রহণযোগ্যতাকেই বাতিল করতে চায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাই ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ‘সিএনএন’— এদের বিরুদ্ধে মাসে দু’বার ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর অভিযোগ করেন। গত পাঁচ বছরে একটাও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি মোদী। আর এ রাজ্যে? সাংবাদিক পেটানোয় পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, প্রশ্ন করায় মমতার উত্তর ছিল, ‘রাজনীতি করবেন না।’ বেগতিক প্রশ্ন করলেই মমতা ‘বিরোধী’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘তুমি কোন কাগজ,’ ‘আপনি কোন চ্যানেল’— এ কথাগুলো তাঁকে বার বার বলতে শোনা গিয়েছে।

এর প্রভাব পড়ে বইকি। গত বছর ভারতে তিন জন সাংবাদিক তাঁদের কাজের জন্য নিহত হন। এ বছরের প্রথম তিন মাসেই খুন হয়েছেন তিন জন সাংবাদিক। সাংবাদিক নিগ্রহ, মানহানি বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা, টুইটারে অনবরত হিংসাত্মক বার্তাও বাড়ছে।

সাংবাদিকের সমাদর, সম্মান কেউ কখনও করেনি। কিন্তু আজ সাংবাদিক নিগ্রহ যে রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের কাজটা যত পরিকল্পিত ভাবে হচ্ছে, তা আগে কখনও হয়নি।

এ রাজ্যে সাংবাদিকের বিপন্নতা কমবে কি? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, নেতাই, লালগড়ে টিভিতে ‘লাইভ’ খবর বামফ্রন্টের সন্ত্রাসের মুখ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তার সুফলটি পান মমতা। তিনি জানেন, সাংবাদিক ‘স্পট’-এ পৌঁছে গেলে কী হতে পারে। তাই রুখে দেওয়া হয়তো এত জরুরি হয়ে উঠছে।

নগ্ন সত্য এটাই। সাংবাদিকের ক্যামেরাই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Journalist Attack on Media Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE