Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

প্রশ্ন রহিয়া গেল

কাদার আদানপ্রদান বন্ধের জন্য প্রথমেই দরকার ছিল, বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া কিছু সংশয় ও প্রশ্নের স্পষ্ট মীমাংসা। অথচ এই মামলার রায়ে মীমাংসার আলোটি শেষ অবধি ফুটিল না।

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:২৫
Share: Save:

বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বযুদ্ধের মীমাংসার চেষ্টা করিবেন না: দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অনুরোধ। যেমন করিয়া ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বাজার-অর্থনীতির মধ্যেই মিটাইয়া লইতে হয়, রাজনৈতিক যুদ্ধও ঠিক তেমন ভাবে গণতন্ত্রের সেই অঙ্গনেই খেলিতে হইবে, যে অঙ্গনে ভোটদাতারা ভোট দিয়া জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করিবার সুযোগ পান। কথাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বিচারবিভাগের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রাজনৈতিক যুদ্ধ ঢুকিয়া পড়িলে বিচারের নিরপেক্ষতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাজনীতির চাপান-উতোরও কুৎসিত ভাবে বর্ধিত হইতে থাকে। তবে কি না, কথাটি যথার্থ ও জরুরি হইলেও একটি বড় ‘কিন্তু’ এই প্রাসঙ্গিক উচ্চারণের পশ্চাতে রহিয়া যায়। যে ভাবে বহু ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বাজারের চৌহদ্দি ছাড়াইয়া সামাজিক পরিসরে পা রাখিবার অবকাশ পায়, সেই ভাবেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকেও স্বাভাবিক ভাবেই নিজেকে বিস্তার করিয়া বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখা যায়। কোনও দেশের কোনও গণতন্ত্রেই ইহার ব্যতিক্রম নাই। যে মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্য, মুহূর্তে বিচারপতি লোয়ার সেই মামলার রায় লইয়া বিজেপি ও কংগ্রেস প্রবল ভাবে পরস্পরের প্রতি শাণিত হইয়া উঠিয়াছে, পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রায় ধাবিয়া যাইতেছে। পুরা চিত্রটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়া অতীব বিপজ্জনক, কুরুচিকর। একটি মামলার প্রেক্ষিতে এই প্রকাশ্য ঘাত-প্রতিঘাত, কুৎসা-হুমকি এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু, সেই সঙ্গে ইহাও না মানিয়া কি উপায় আছে যে, কিছু কিছু মামলার মধ্যে রাজনীতির প্রশ্নগুলি অভ্রান্ত ক্ষিপ্রতায় ঢুকিয়া পড়ে? বিচারপতি লোয়ার মামলাটিও কিন্তু তেমনই একটি ক্ষেত্র ছিল। মামলার চূড়ান্ত রায়ে সেই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্তোষজনক ভাবে মিলে নাই। সেই কারণেই রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ি আজ এই উচ্চতায় পৌঁছাইতে পারিয়াছে। যে শুভবুদ্ধি দিয়া তাহা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, সেই বুদ্ধি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাড়ন্ত, সুতরাং রাজনীতি আটকাইবার আশাও সামান্য।

কাদার আদানপ্রদান বন্ধের জন্য প্রথমেই দরকার ছিল, বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া কিছু সংশয় ও প্রশ্নের স্পষ্ট মীমাংসা। অথচ এই মামলার রায়ে মীমাংসার আলোটি শেষ অবধি ফুটিল না। এই আক্ষেপ কেবল সাধারণ নাগরিকের নহে, আইনজীবীরা অনেকেই এমন মত প্রকাশ করিয়াছেন। বর্ষীয়ান আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ এই মামলায় বেশ কিছু পদ্ধতিগত সমস্যার কথা বলিয়াছেন। প্রাক্তন অ্যাটর্নি-জেনারেল সোলি সোরাবজি রায় লইয়া গভীর প্রশ্ন তুলিয়াছেন: যে কোনও সংবেদনশীল মামলার ক্ষেত্রে প্রদত্ত রায়টির একটি ‘ক্লোজার’ বা যবনিকা লইয়া আসিবার কথা। কিন্তু এত সন্দেহ ও প্রশ্ন যদি রায় ঘোষণার পরও থাকিয়া য়ায়, তবে কি সত্যই যবনিকার খোঁজ মিলে?

বিচারের রায় বিষয়ে সাধারণ্যের মনোভাব বা মতামত আদৌ প্রাসঙ্গিক কি না, তাহাও ভাবিতে হইবে। মামলার গতি কোন দিকে যাইবে, তাহা নিশ্চয়ই বিচারালয়ের বাহিরে কেহ বলিতে পারেন না, তাঁহাদের সে এক্তিয়ার নাই। কিন্তু যে ঘটনা দিনের পর দিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হইবার ফলে বহু তথ্য, বহু প্রশ্ন জনসমক্ষে আসিয়াছে, তাহার প্রেক্ষিতে বিচারকদের বিশেষ কিছু দায়িত্বও থাকিয়া যায়। তাঁহাদের রায় গহ্বরগর্তগুলিতে কিছু আলোকসম্পাত করিবে, সেই প্রত্যাশা থাকিয়া যায়। সুবিচার কেবল সংকীর্ণ অর্থে পদ্ধতিগত অবরোহণ হইলেই কি চলে, না কি তাহাকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে সুবিচার বলিয়া প্রতিভাতও হইতে হয়, লোয়ার মামলার রায় সেই দ্বন্দ্বের সামনে আর এক বার দাঁড় করাইয়া দিল। গণতন্ত্রে দ্বন্দ্বটিকে সামান্য বলা চলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

justice Judicial system
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE