Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

যথার্থ অভিভাবক

একটি গুরুতর বিষয় সুপ্রিম কোর্টের এ বারের রায়ের ফলে এই নির্দেশিকায় যুক্ত হইল: ফ্লোর টেস্ট বা বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরীক্ষার জন্য কতখানি সময় দেওয়া যাইবে, সেই বিবেচনা রাজ্যপালের থাকা জরুরি।

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০০:১৬
Share: Save:

গোড়া হইতেই ভারতীয় গণতন্ত্রে একটি নীতির উপর বিশেষ জোর পড়িয়াছিল— আদালত যেন দেশ না চালায়। বিচারবিভাগ, শাসনবিভাগ ও আইনবিভাগ— শাসনতন্ত্রের এই তিনটি অংশের মধ্যে যেন পারস্পরিক নির্ভরতা থাকে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে যেন যথেষ্ট দৃষ্টিগ্রাহ্য দূরত্বও থাকে। অর্থাৎ, যাহার যাহা কাজ। আদালতের রায় আর দেশের আইনের কাজ ঠিক এক নহে, আর সেই পার্থক্য বাস্তবে বজায় রাখিবার জন্য বার বার সেই লাতিন মন্ত্রটি আউড়ানো হইয়াছে: ‘অবিটার ডিকটা’ (অর্থাৎ আদালত যাহা বলিয়াছে তাহা প্রেক্ষিত-নিরপেক্ষ নহে, প্রেক্ষিতনির্ভর নির্দেশ)। এতৎসত্ত্বেও বলিতেই হয়, এ দেশের গণতন্ত্র নিজের গতিতে চলিতে চলিতে এমন অনেক দুর্বিপাকে পড়িয়াছে যখন বিচারবিভাগের, বিশেষত সুপ্রিম কোর্টের কোনও কোনও সিদ্ধান্ত নিকষ আঁধারে প্রাণ-বাঁচানো আলোকরেখার মতোই ঠেকিয়াছে। এ বারের কর্নাটকের সঙ্কটের ক্ষেত্রটিও সম্ভবত তেমন দৃষ্টান্ত হইয়া রহিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিজেপি সে রাজ্যে সরকার গড়িতে পারিল না, বুকানাকেরে সিদ্দালিঙ্গাপ্পা ইয়েদুরাপ্পার উচ্চাশায় জল ঢালা হইল, ইত্যাদি ছাপাইয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জাগিয়া থাকিল: ভবিষ্যতে ‘ত্রিশঙ্কু বিধানসভা’ উদ্ভূত হইলে, অর্থাৎ নির্বাচনে কোনও দল বা প্রাক-নির্বাচনী জোট একক ভাবে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পাইলে সরকার গড়িবার পদ্ধতিটি কী হওয়া উচিত। এই রায়ের ফলে সে বিষয়ে ধারণা অনেক স্পষ্ট হইল। সুপ্রিম কোর্টের পূর্বের রায়গুলির সহিত ইহা সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যময়। অতীত ও বর্তমান রায়গুলি একত্র বিচার করিলে বুঝা যায়, রাজ্যপাল তথা কোনও একক ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের উপর বিষয়টি নির্ভর করে না। নির্বাচন-উত্তর বিভক্ত ফলের প্রেক্ষিতে কে সরকার গড়িবার প্রথম ও তৎপরবর্তী ডাক পাইবেন, ইহার একটি সুস্পষ্ট সাংবিধানিক নির্দেশিকা তৈরি হইয়া গিয়াছে। অতঃপর তাহাকে মান্য না করিয়া উপায় নাই।

একটি গুরুতর বিষয় সুপ্রিম কোর্টের এ বারের রায়ের ফলে এই নির্দেশিকায় যুক্ত হইল: ফ্লোর টেস্ট বা বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরীক্ষার জন্য কতখানি সময় দেওয়া যাইবে, সেই বিবেচনা রাজ্যপালের থাকা জরুরি। সেই অর্থে সর্বোচ্চ আদালতের এ বারের রায়টি অত্যন্ত দৃঢ় এবং প্রয়োজনীয়। দুই সপ্তাহের বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরীক্ষার সময় দুই দিনে নামাইয়া আনিবার মধ্যে এমন একটি সুস্থিত দূরদৃষ্টি রহিয়াছে যাহা দেশের বিচারবিভাগের উপর নাগরিকের শ্রদ্ধা বাড়াইয়া দিবার জন্য যথেষ্ট। সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারকরা যে সে দিন গভীর রাত্রিতেই বিচারকার্যে বসিয়াছিলেন, এই অভূতপূর্ব ঘটনা শ্রদ্ধাকে আরও বাড়াইয়া দেয়। এমন অভিভাবক থাকিলে গণতন্ত্র নিশ্চিন্তে ডালপালা বিস্তার করিতে পারে। অন্যান্য নবীন ও নাতি-প্রবীণ গণতন্ত্রের কাছেও ইহা দৃষ্টান্তযোগ্য হইয়া থাকিবে।

সাম্প্রতিক অতীতে সুপ্রিম কোর্টের ভিতরে অনেক বিভাজন ও অনৈক্যের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়াছে। ইঙ্গিত ছাড়াইয়া কখনও তাহা বিক্ষোভের প্রত্যক্ষতাতেও পৌঁছাইয়াছে। এই সব ঘটনায় সর্বোচ্চ আদালতের সর্বমান্যতা লইয়া নাগরিকমানসে কিছু সংশয় তৈয়ারি হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু তাহার খুব প্রয়োজনীয় সংশোধন ঘটিয়া গেল এই কর্নাটক-সঙ্কট পর্বে। আরও এক বার দেশের সর্বোচ্চ আদালত বুঝাইয়া দিল, তাহার বিবেচনা ও নিরপেক্ষতার ভাণ্ডার কতখানি সমৃদ্ধ। মামলায় কে হারিল কে জিতিল, বৃহত্তর বিচারে সবই নেহাত আপতিক। আসল কথা, কর্নাটক-কাণ্ডে প্রমাণ হইল যে ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোটি কত জোরালো, এবং বিচারবিভাগের হাতে তাহা কত সুরক্ষিত। সেই তুলনায় অন্যান্য বিভাগ যথেষ্ট যোগ্যতার অধিকারী কি না, তাহা অবশ্যই ভিন্ন প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Karnataka Election 2018 Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE