আন্দোলন: লালগড়। নভেম্বর, ২০০৮
ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার গোপন ঘাঁটিতে সিপিআই (মাওবাদী) দলের একটি বিশেষ প্লেনাম হয় ২০০৮-এর এপ্রিলে। প্লেনামটি তড়িঘড়ি করতে হয়েছিল। কারণ, তার মাস দেড়েক আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান টানা তিন বছর পশ্চিমবঙ্গে দলের রাজ্য সম্পাদক থাকা সোমেন ওরফে হিমাদ্রি সেন রায়। ওই প্লেনামে সোমেনের উত্তরসূরি হন সুদীপ চোংদার ওরফে কাঞ্চন। একই প্লেনামে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে পার্টি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেটা হল, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার (এখন ঝাড়গ্রাম জেলায়) লালগড় থেকে পার্টি ক্রমশ নিজেকে সরিয়ে নেবে। পার্টি মনে করেছিল, প্রায় দেড় দশক ধরে ওখানে সাংগঠনিক কাজ চললেও জনভিত্তি তেমন গড়ে ওঠেনি, বিপ্লবী কার্যকলাপ দানা বাঁধছে না ওখানে আর মনোনিবেশ করা মানে অযথা শক্তিক্ষয়।
আর ওই প্লেনামের সাত মাসের মাথায় লালগড়ে যা হল, তা ইতিহাস। লালগড় আন্দোলনের ফলে পরবর্তী আড়াই-তিন বছর যাবৎ এই রাজ্যে মাওবাদীরা এক অপরিহার্য প্রাসঙ্গিক শক্তিতে পরিণত হলেন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় মাওবাদী তথা সশস্ত্র অতি-বাম রাজনীতি ও তার ফসল নতুন এক মাত্রা ও গুরুত্ব পেল। এখনও যে পশ্চিমবঙ্গে ৩২ কোম্পানি সিআরপিএফ ঘাঁটি গেড়ে আছে, তা ওই লালগড় আন্দোলনের স্মৃতি তাড়া করে বেড়াচ্ছে বলে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি মতো জঙ্গলমহল এখন হাসছে বলে ধরে নেওয়া হলে, তারও শিকড় লালগড়ে।
আন্দোলনের জ্বলন্ত সেই সব দিনে মাওবাদী নেতৃত্ব বার বার বলতেন চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি আন্দোলনের আদর্শে তাঁদের প্রাণিত হওয়ার কথা। জঙ্গলমহলের তল্লাটে তল্লাটে প্রচার করতেন, নকশালবাড়িই তাঁদের শিখিয়েছে, সাধারণ মানুষের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্পিত হতে হবে, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উন্নয়নের পরিকল্পনায় গরিব মানুষই নিজের অধিকারে অংশগ্রহণ করবেন। এবং লালগড়কে কেন্দ্র করে উত্তাল জঙ্গলমহলের মানুষ সেই পথেই হাঁটতে শুরু করেছিলেন। শহর থেকে গিয়ে টুপ করে মাথার উপর পড়া কেউ নন, নেতারা উঠে এসেছিলেন প্রত্যন্ত গ্রামের লাল মাটি থেকে। আর্থিক মাপকাঠিতে যাঁরা হতদরিদ্র, সামাজিক অবস্থানে যাঁরা তফসিলি জনজাতি কিংবা অন্যান্য দলিত শ্রেণির প্রতিনিধি। মাওবাদী নেতৃত্বের একাংশ তখন লালগড়কে ‘দ্বিতীয় নকশালবাড়ি’ বলেও উল্লেখ করেছেন। কারণ, নকশালবাড়ি দ্বারা উজ্জীবিত অন্য কোনও আন্দোলন এই রাজ্যে লালগড়ের মতো এমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
অথচ এখন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বক্তৃতা, লেখালিখি, সভায়-বৈঠকে লালগড় ঘোরতর ভাবে অনুপস্থিত, অনুচ্চারিত। সবাই স্মৃতিচারণায় বুঁদ। কেউ অজানা দলিল সামনে এনে নিজেদের ভুলের কথা স্বীকার করছেন, কেউ চারু মজুমদারের মতো কোনও হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার খোঁজ করে যাচ্ছেন। সবটাই সেই রুদ্ধশ্বাস অতীতকে ভেবে রক্ত প্রবাহ চঞ্চল করা। কিন্তু নকশালবাড়ি বিপুল সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, শুধু এটুকু বলেই থেমে গেলে জঙ্গলমহলের মানুষদের এক রকম অসম্মান করা হয়। কারণ, তা হলে মেনে নিতে হয়, এ রাজ্যের মানুষের বিপ্লবী সংগ্রামের পথ সত্তরের দশকের গোড়ায় তৈরি অবরোধের বেড়া আর কোনও দিন টপকাতে পারেনি। এটা অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের কথা বলতে গিয়ে ‘পথের পাঁচালি’র বাইরে না বেরোনোর মতো।
বোধ হয় এ ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে একটা দীনতা কাজ করে— শহুরে, ভদ্রলোকি ও তথাকথিত শিক্ষিতের দীনতা। প্রথম কথা, শহর ও শহরাঞ্চলের মানুষদের হাতে লালগড় আন্দোলনের রাশ কখনও যায়নি, সেখানে এই আন্দোলনও ছড়ায়নি, যার উল্টোটা হয়েছিল নকশাল আন্দোলনের সময়ে। লালগড়ে গোটা আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল গ্রাম। নকশাল অধ্যায়ের ‘আরবান অ্যাকশন স্কোয়াড’ বলে কিছুর অস্তিত্ব লালগড়ে ছিল না। প্রেসিডেন্সি-যাদবপুর সেখান থেকে অনেক দূরে ছিল। আন্দোলনের নেতারা— ছত্রধর মাহাতো, মনসারাম হেমব্রম, শশধর মাহাতো, বটো বাস্কে, লালমোহন টুডু, কেউ সমাজের উপরতলার নন। কলকাতা ময়দানে, শহিদ মিনারের পাদদেশে কোনও সভা লালগড় নিয়ে হয়নি, শহরের রাজপথে রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশ মারা যাননি। যা হয়েছিল, সব গ্রামে, বড়জোর ঝাড়গ্রাম শহরে। সেই জন্যই কি লালগড়ের অধিকার নেই নকশালবাড়ির অর্ধশতবর্ষ পূর্তিতে একই পঙ্ক্তিতে উচ্চারিত হওয়ার?
নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান ১৯৬৯ সালে সিপিআই (এমএল)-এর জন্ম দিয়েছিল। লালগড় আন্দোলন কোনও পার্টির জন্ম দেয়নি। সিপিআই (মাওবাদী) ২০০৪ সেপ্টেম্বরে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবে মিলটা এখানেই যে, নকশালবাড়ির বড়ঝারুজোত ও প্রসাদজোত গ্রামে পুলিশ আগ্রাসন ও প্রাণহানির জেরে শুরু হওয়া আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত জনতার সংগ্রাম। তেমনই ২০০৮-এর ৫ নভেম্বর গভীর রাতে লালগড়ের ছোটপেলিয়া গ্রামে মাওবাদী নেতা করন হেমব্রমের খোঁজে ঢুকে পুলিশ মহিলাদের নিগ্রহ করায় পর দিন সকাল থেকে গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে, রাস্তা কেটে লালগড়ের মানুষও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নামেন। পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন অচিরেই বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের দাবির সংগ্রামে পরিণত হল। এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু দিন সাতেকের মাথায় তার রশি মাওবাদীদের হাতে চলে আসে। ১৫ বছর ধরে লালগড়ে জমি তৈরি করার আশানুরূপ ফসল পাচ্ছিলেন না বলে হতাশ যে মাওবাদীরা জমিটাই ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, ৬ নভেম্বরের পরিস্থিতি তাঁদের সুদে-আসলে সব ফেরত দিয়েছিল।
আর লালগড়ে আন্দোলন গণমুক্তি গেরিলা ফৌজ গঠন ও হিংসাত্মক কার্যকলাপে সীমাবদ্ধ ছিল না। পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটিকে সামনে রেখে গণ-আন্দোলন পরিচালনা ছাড়াও সমান্তরাল প্রশাসন-পরিষেবা চালু করা হয়েছিল। ২০১০-এ শালবনি এলাকার মধুপুর গ্রামে গিয়ে দেখেছি, মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রিত কমিটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, রাস্তা, কাঠের সেতু তৈরি তো বটেই, গ্রাম লাগোয়া ঝোরা থেকে দেশি প্রযুক্তিতে জল তুলে সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। আবার তদানীন্তন শাসক দলের ক্যাডার কিংবা পুলিশ ঢুকতে গেলে মানুষই ল্যান্ডমাইন ফাটিয়ে বাধা দিচ্ছেন। লালগড়ে মাওবাদীদের সশস্ত্র প্ল্যাটুন (৩৫ জন সদস্য) গড়ার প্রধান কারিগর করন হেমব্রমের কথায়, ‘নকশাল আন্দোলনের মতো শুধু খতমের রাজনীতি আমরা করিনি। তা হলে লালগড় আন্দোলনই হত না।’
চারু মজুমদার নির্দেশিত স্কোয়াড বা গোপন কমব্যাট গ্রুপের অ্যাকশনে আটকে না থেকে লালগড় প্রথম দিকে গুরুত্ব দিয়েছিল গণ-আন্দোলনকে, মর্যাদা দিয়েছিল মানুষের অধিকারকে। অথচ নকশালবাড়ি আন্দোলনের বর্ধিত সংস্করণ হিসেবে মর্যাদা পায়নি দলিলপুর চকে শুরু হওয়া সেই গণ অভ্যুত্থান। সুবর্ণজয়ন্তীতেও পেল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy