Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি (১৯৪৫-২০১৭)

অবিভক্ত ভারতের (অধুনা বাংলাদেশ) পূর্ব দিনাজপুর জেলার চিড়িবন্দরে প্রিয়রঞ্জনের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৩ নভেম্বর।

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

তাঁর পেশাগত পরিচিতি দিতে গিয়ে লোকসভার ওয়েবসাইট লিখেছে: ‘উপদেষ্টা, আইনজীবী, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক ও সমাজকর্মী’।

রাজনীতিতে অভ্যুত্থান ষাটের দশকে। পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র পরিষদের হাত ধরে। ছাত্র থেকে যুব সংগঠন হয়ে পুরোদস্তুর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি এবং সেই সূত্রে এআইসিসি-তে প্রতিষ্ঠা সত্তরের দশকে। সব মিলিয়ে পাঁচ বার এ রাজ্য থেকে লোকসভায় নির্বাচিত। দু’দফায় মোট চারটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানো। হাই-প্রোফাইল রাজনীতিকের দায়িত্ব সামলানোর ফাঁকেই টানা কুড়ি বছর অবিচ্ছিন্ন ভাবে এআইএফএফ-এর সভাপতি। চুম্বকে এই হল প্রিয়রঞ্জনের ‘পাবলিক কেরিয়ার’।

আরও পড়ুন: কাছের মানুষ ছিলেন প্রিয়দা

অবিভক্ত ভারতের (অধুনা বাংলাদেশ) পূর্ব দিনাজপুর জেলার চিড়িবন্দরে প্রিয়রঞ্জনের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৩ নভেম্বর। শিক্ষাগত যোগ্যতায় এমএ এবং এলএলবি। পড়াশোনা রায়গঞ্জ কলেজে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লোকসভার সাংসদ হিসাবে ১৯৭১ সালে প্রথম বার নির্বাচিত (বামপন্থী গণেশ ঘোষকে হারিয়ে সেই প্রথম দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে জিতল কংগ্রেস) হওয়ার আগেই রাজ্য যুব কংগ্রেস সভাপতি। তার দু’বছরের মধ্যেই প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। লোকসভায় দ্বিতীয় বার নির্বাচিত ১৯৮৪ সালে। তার আগে ১৯৮০ থেকে ’৮২ পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। দ্বিতীয় দফায় ওই পদ সামলেছেন ১৯৮৫ থেকে ’৮৮ পর্যন্ত, যে সময়টায় তিনি আবার কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।

তৃতীয় এবং শেষ বার প্রদেশ সভাপতির পদ (মাঝে অবশ্য ’৯৮-এ কার্যনির্বাহী সভাপতি হয়েছেন) প্রিয়রঞ্জনের কাছে এসেছিল অসুস্থ হয়ে পড়ার কয়েক মাস আগে। তখনও তিনি একই সঙ্গে কেন্দ্রে তথ্য ও সম্প্রচার এবং সংসদীয় মন্ত্রকের দায়িত্বে। প্রদেশের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে সংসদীয় মন্ত্রকের ভার অবশ্য ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রিয়রঞ্জনকে জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্বে আসার আগে ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ত্রয়োদশ লোকসভায় কংগ্রেসের মুখ্য সচেতকের দায়িত্ব পালন করেছেন যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে। এআইসিসি এবং সংসদের অজস্র কমিটির কাজ তো আছেই!

কিন্তু এ তো নেহাতই সালতামামি! কংগ্রেস রাজনীতি প্রিয়রঞ্জনকে মনে রাখবে কেন?

ভাবী কাল তাঁকে মনে রাখবে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস রাজনীতিতে নতুন এক ধারা প্রবর্তনের জন্য। ছাত্র রাজনীতিকে আঁতুড়ঘর ধরে যুব রাজনীতি হয়ে একেবারে রাজধানীর রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার এই পথটা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির পরে আর কেউ এতটা সফলভাবে পেরোতে পারেননি। অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে, দশ জনের এক জন হয়ে না-থেকে দশ জনের নেতা হয়ে ওঠা, ঐতিহ্যগত কংগ্রেসি রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে ছাত্র-যুব রাজনীতিতে জোর দেওয়া, ইন্দিরা গাঁধীর প্রিয়তম পাত্র হয়ে ওঠা, জরুরি অবস্থা নিয়ে সঞ্জয় গাঁধীর সঙ্গে বিরোধে সেই আসন থেকে চ্যুত হওয়া এবং কালক্রমে সেখানে ফিরে যাওয়া— প্রিয়রঞ্জনের রাজনীতি এখানেই আলাদা। ফলে অনেক বর্ণময়। তীব্র নাটকীয় ছিল তাঁর উত্থান। প্রায় ধূমকেতুর মতো। বোধহয় সেই জন্যই ক্রমাগত উথালপাথাল কংগ্রেসি রাজনীতিতে সমসাময়িকদের ছাড়িয়ে টিকে গিয়েছিলেন ‘মুন্সিজি’।

বলা কঠিন যে, তুঙ্গ সাফল্য পেয়েছিলেন। কারণ জরুরি অবস্থার পরবর্তী সময়ে যে প্রিয়রঞ্জনকে দেখা গেল, তাঁর মধ্যে আগেকার সাহস অনুপস্থিত। হয়তো সঞ্জয় গাঁধীর সঙ্গে বিরোধে সেই একরোখা আত্মবিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। যে কোনও কারণেই হোক, জরুরি অবস্থা-পূর্ব প্রিয়রঞ্জনের ছাপ জরুরি অবস্থা-উত্তর প্রিয়রঞ্জনের উপর সে ভাবে পড়েনি।

কেন? একটা বড় কারণ সম্ভবত এই যে, প্রিয়রঞ্জন নিজেকে গড়েছিলেন কংগ্রেসের অন্দরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়দের মতো ‘প্রগতিশীল’ রুশপন্থীদের ছায়ায়। কংগ্রেসের ‘সোভিয়েত লবি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। তাই সিপিআই যে হাওয়ায় মিইয়ে গেল, প্রিয়রঞ্জনের পক্ষেও সেই হাওয়া সুপবন ছিল না। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের ভিতরে ‘প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী’। কিন্তু জরুরি অবস্থা পরবর্তী পর্যায়ে তো বামপন্থার সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল! ফলে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল তাঁর রাজনীতির ভিতটাই।

ঠিক যে ভাবে অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেনের কংগ্রেসি রাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক করে উঠে এসেছিলেন প্রিয়রঞ্জন নিজে। নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি সত্ত্বেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে যেমন খাপ খাওয়াতে পারেননি ওই বর্ষীয়ান নেতারা, তেমনই পরিবর্তিত রাজনৈতিক ধারায় সম্ভবত পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারেননি প্রিয়রঞ্জনও।

না হলে আপ্লুত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় যাঁকে ‘দ্বিতীয় নেতাজি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁকে কেন আপাদমস্তক রাজনীতির বৃত্ত ভাগ করে দিতে হল ফুটবলের দুনিয়ায়?

তবু প্রিয়রঞ্জনের সাফল্য একেবারে তুচ্ছও নয়। কংগ্রেস রাজনীতির দোলাচলের মধ্যেও তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, অসুস্থ হয়ে বিদায়ের লগ্নেও তিনি ছিলেন দিল্লির দরবারে হাতে-গোনা গুরুত্বপূর্ণ বাঙালিদের অন্যতম, এটা কম কথা নয়। এই সাফল্যের রসায়ন কী? প্রথমত, কংগ্রেসের ‘সামন্ততান্ত্রিক’ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে ধুতি-শার্ট পরে হ্যান্ড-মাইক নিয়ে ভোট প্রচারে নেমে তিনি সংগঠনকে নির্মাণ করেছিলেন। ‘জমিদারি’ (খারাপ অর্থে নয়) প্রথায় চলতে অভ্যস্ত বাবুয়ানির কংগ্রেস তার নিম্নবর্গীয় ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছিল। প্রিয়রঞ্জন তা থেকে সংগঠনকে মুক্ত করে এনেছিলেন। কালের নিয়মে কংগ্রেসে যে আগ্রাসী রাজনীতির চাহিদা তৈরি হয়েছিল, ছাত্র-যুব রাজনীতিকে হাতিয়ার করে তার উপযুক্ত সওয়ার হয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন। সংগঠনে নিয়ে এসেছিলেন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবর্গীয় ঘরের ছেলেদের। কংগ্রেসও যে ‘বিদ্রোহী রাজনীতি’ করতে পারে, তাদেরও যে একটা ‘লড়াকু মুখ’ থাকতে পারে এবং বামপন্থী অবস্থান নিয়েও বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, সেটা প্রথম দেখিয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জনই।

এর সঙ্গে যোগ হয় তাঁর বক্তৃতার ‘স্টাইল’। অতুল্য ঘোষ, সোমনাথ লাহিড়ীর মতো নেতাদের মিলিয়ে মিশিয়ে বক্তৃতার একটা নতুন ধারা শুরু করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন। মানুষকে যা টানত। নিজে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে-আসা প্রিয়রঞ্জন ছাত্র ও যুব স্তর থেকে যে ভাবে ছেলেদের ‘তুলে’ আনতেন, তার সুফলও কংগ্রেস ঘরে তুলছে।

তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম-বিরোধী আন্দোলনের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার পরে প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয়েছে বারবার। কিন্তু বাংলায় বাম শাসনের অবসান তিনি চাইতেন, এটা ঘটনা। যদিও সুস্থ অবস্থায় তিনি তা দেখতে পারলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE