Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

বিপরীত গতি

আগে আলোচনা, অতঃপর সিদ্ধান্ত, তাহার পর ঘোষণা। নীতি প্রণয়ন বা পরিবর্তনের ইহাই চিরকালীন পথ। ভারতে এখন বিপরীত গতি। গোড়ায় নেতারা সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করিয়া দেন, তাহার পর নীতি প্রণয়ন হয়, অবশেষে আলোচনা।

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

আগে আলোচনা, অতঃপর সিদ্ধান্ত, তাহার পর ঘোষণা। নীতি প্রণয়ন বা পরিবর্তনের ইহাই চিরকালীন পথ। ভারতে এখন বিপরীত গতি। গোড়ায় নেতারা সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করিয়া দেন, তাহার পর নীতি প্রণয়ন হয়, অবশেষে আলোচনা। ঔষধের জেনেরিক বা উপাদান-অনুসারী নাম লিখিবার বিষয়টি লইয়াও তেমনটাই হইল। এপ্রিলের মাঝামাঝি নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করিলেন, ব্যবস্থাপত্রে ঔষধের জেনেরিক নাম না লিখিলে চিকিৎসকদের শাস্তি হইবে। সপ্তাহ না ঘুরিতেই মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া নির্দেশ জারি করিল, স্পষ্টাক্ষরে জেনেরিক ঔষধের নাম না লিখিলেই শাস্তি। অতঃপর, তুমুল বিতর্ক। বিবিধ প্রশ্নের মুখে পড়িয়া সুর বদলাইয়াছে মেডিক্যাল কাউন্সিল। এখন তাহাদের বক্তব্য, ঔষধের ব্র্যান্ড লিখিলে সমস্যা নাই, তবে তাহার সহিত জেনেরিক নামটিও লিখিতে হইবে।

জেনেরিক নাম লিখিতে বাধ্য হইলে ডাক্তারদের মধ্যে দামি ঔষধ লিখিবার প্রবণতা বন্ধ করা যাইবে, ইহাই ছিল মূল যুক্তি। ঔষধের ‘ব্র্যান্ডনেম’ লিখিতেই যদি বাধা না থাকে, তবে জেনেরিক নামের বাহুল্যটি আর কেন? সংস্কারের নামে যাহা হইল, তাহা নিতান্ত প্রহসন। কোনও একটি ক্ষেত্রে যাঁহারা গুরুত্বপূর্ণ ‘স্টেকহোল্ডার’, সিদ্ধান্ত করিবার পূর্বে তাঁহাদের সহিত আলোচনা করা যে শুধু গণতন্ত্রের দার্শনিক চাহিদা, তাহা নহে— রণকৌশল হিসাবেও তাহা গুরুত্বপূর্ণ। গোড়াতেই চিকিৎসক সংগঠনগুলির সঙ্গে পরামর্শ করিয়া, তাহাদের যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা বিচার করিয়া অগ্রসর হইবার পরিচিত পথটি ধরিলে হয়তো এই কুনাট্য এড়ানো সম্ভব হইত। বস্তুত, নাগরিক সমাজের পরিসরে প্রশ্নগুলি উত্থাপিত হইলে বহুতর মতের আদানপ্রদানে হয়তো সর্বজনগ্রাহ্য কোনও পথের সন্ধান মিলিত। কিন্তু, ছাতির মাপ খানিক কমিয়া গেলেও ‘বিকাশপুরুষ’ যে এখনও একাই দেশের সব সমস্যার সমাধান করিতে বদ্ধপরিকর, ভুলিলে চলিবে কেন?

পশ্চিমবঙ্গেও সরকার কোনও আলোচনা ছাড়াই ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট সংশোধন করিল। ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন’-ও তৈরি হইল। অতঃপর আলোচনার পালা। চিকিৎসকেরা কমিশনের কর্তৃত্ব মানিতে নারাজ। তাঁহাদের যুক্তিগুলি কেন গোড়াতেই শোনা হয় নাই, এ রহস্য ভেদ হইবার নয়। কিন্তু চাপের মুখে বিধি শিথিল হইতেছে। চিকিৎসকদের অবহেলার বিচার নূতন কমিশনের অধীনে পড়িবে, নাকি কেবল হাসপাতালের ত্রুটিই বিচার্য হইবে, তাহা লইয়া বিতর্ক চলিতেছে। তবে কি চিকিৎসক ও হাসপাতাল, দু’তরফের বিরুদ্ধেই অভিযোগ থাকিলে দুটি ভিন্ন স্থানে অভিযোগ জানাইতে হইবে? তাহাতে কি রোগীর পরিবারের হয়রানি কমিবে? নিষ্পত্তি দ্রুত হইবে? সকলই ধোঁয়াশা। এই সমস্যা শুধু স্বাস্থ্যক্ষেত্রের নহে। ইহাই এখন সরকারি স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মান্য পদ্ধতি। গণতন্ত্র মানে যে কেবল পাঁচ বৎসর অন্তর নির্বাচনের উৎসব নহে, নীতিনির্ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রই ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসি’-র পরিসর— কেবল ‘স্টেকহোল্ডার’-দের নহে, বৃহত্তর নাগরিক সমাজের মতামত লওয়া নীতিনির্ধারণের প্রাথমিক শর্ত— এই কথাটি রাজনীতির ‘সুপারম্যান’রা বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন। প্রশাসনিকতার উপর তাহার প্রভাব, অতএব, অনিবার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Leaders decision policy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE