Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

তাঁর শিক্ষা আজ পরম পাথেয়

পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য চরিত্র তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ইতিহাসচেতনার সমগ্রতা নিয়েই বলেছেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারবরিষ্ঠ।’ ধর্মে ধর্মে এত বিদ্বেষ দেখে এ যুগের মানুষ ধর্মকেই বিদায় দিতে চেয়েছে; দিয়েছেও।

আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮২তম জন্মতিথি

আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮২তম জন্মতিথি

স্বামী সুপর্ণানন্দ
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য চরিত্র তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ইতিহাসচেতনার সমগ্রতা নিয়েই বলেছেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারবরিষ্ঠ।’ ধর্মে ধর্মে এত বিদ্বেষ দেখে এ যুগের মানুষ ধর্মকেই বিদায় দিতে চেয়েছে; দিয়েছেও। ধর্ম তো মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে শান্তি স্থাপন করবে! কিন্তু কী দেখতে পাই এবং এখনও। পৃথিবীটা যেন ঈশ্বরকে নিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত। ভারতভূমির এই অবস্থা। পৃথিবীর মানচিত্রটাও ততোধিক কলুষিত। অবস্থা এমনই যে এখন এক সম্প্রদায়ের অনুগামীদের অসংখ্য শত্রু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। সবাই ভগবানের কাছে যাবেন, বেশ। অন্যদের শত্রু ভেবে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নতি বিধানের দায় তাঁরা কোথায় পেলেন? তাঁদের অবতার তো সর্বজীবে প্রেম বিতরণই করেছেন। তবে?

এই প্রেক্ষিতে শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা আমাদের পরম পাথেয়। এই শিক্ষা এক কথায় অনন্য। তিনি জানালেন, জানাতে বললেন নরেন্দ্রনাথকে: এ পর্যন্ত ধর্মজগতে যত মত প্রচারিত হয়েছে (ভবিষ্যতেও যা হবে), সবগুলিই সত্য। তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যই প্রচারিত হয়েছে। সেই সত্যই মঠ-মিশনের মধ্যে আচরিত হয়। মঠের সন্ন্যাসীদের ভিতর যেমন জন্মসূত্রে সর্বধর্মের মানুষ আছেন, তেমনি ভক্তদের ভিতরও এঁরা সবাই আছেন। তিনি নারীকে নরকের দ্বার বলেননি, বলেছেন মা আনন্দময়ী, মা ভবতারিণীর সাক্ষাৎ মূর্তি। তাঁকে সন্ধান করো, পূজা করো, তিনি পথ না ছাড়লে জীব পথ পাবে না, তাঁরই নির্দেশ মেনে মা সারদা দেবীকে কেন্দ্রে রেখে স্ত্রী মঠের আবির্ভাব। এ এক নূতন বার্তা। নারীদের উপর হাজার হাজার বছরের অবিচার শেষ হল।

শাস্ত্র না পড়লে যে দিব্যদৃষ্টি খুলবে না, তা নয়। নিরক্ষর হলেও মা-ই সব দেখিয়ে দেন। তিনি ‘অশেষ ধর্মসমন্বয়তনু’ এবং ‘অনন্ত ভাবসাগরময়’। কামিনীকে ত্যাগ না করে তাঁকে মাতৃভাবে শুদ্ধ করে সহায় করে নিয়েছেন নিজে। ভক্তদেরও তাই নির্দেশ: দু’একটি ছেলেমেয়ে হলে স্বামী-স্ত্রী ভাইবোনের মতো থাকবে, কাঞ্চনকে সেবায় লাগাবে, শিবসেবায় কাঞ্চনের সদ্ব্যবহার হবে। এ সব পজিটিভ শিক্ষা। যোগের সমন্বয় সাধন এক আশ্চর্য ব্যাপার। কর্ম তো সেবাই এবং সেটিই বড় সহায়। কর্মকে শুদ্ধ করতে হবে, কর্মকে ভালবেসে। সুতরাং কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান সহযোগে মনকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করাই যোগ। এই ‘যোগ’ একটিই। সব পথগুলিই সম্মানের। ফল লাভ হয় যে! তাঁর সত্যনিষ্ঠাও বিস্ময়ের ব্যাপার।

তিনি এলেন; আবার সর্ব ধর্মমত উজ্জীবিত হয়ে উঠল। খ্রিস্ট সত্য হলেন, মহম্মদ সত্য হলেন, বুদ্ধ সত্য হলেন, রাম, কৃষ্ণ, সীতা সব সত্য হলেন তাঁর জীবনে। এবং পরোক্ষত আমাদের জীবনেও। আমরা জয় দিই তাঁরই নামে; তাঁরই নামে সবাই সুরক্ষিত, সবাই নিশ্চিন্ত। জয়ধ্বনির ঘোষণা এমনই হবে: জয় হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ সব ধর্মের জয়; জয় বেদ-বাইবেল, কোরান-পুরাণের জয়, জয় জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, যোগের জয়; জয় বুদ্ধ, রাম, কৃষ্ণ, খ্রিস্ট, মহম্মদ, চৈতন্য— সব অবতারদের জয়। জয় সর্বধর্মের, সর্বভাবের, সর্ব অবতারের ঘনীভূত প্রতিমা শ্রীরামকৃষ্ণের জয়। সবার ধর্মই তাঁর ধর্ম। তাঁর নিজের কোনও ধর্ম নেই। তাই তিনি উদার, শ্রেষ্ঠ এবং গভীরতম। তাঁকে ধরেই পৃথিবী বাঁচবে। তাঁর বার্তা যে গ্রহণের, বাতিলের নয়।

শেষ করি তাঁর আগমনের তাৎপর্য উল্লেখ করে। সবধর্মকে মান্যতা দিয়ে তিনি প্রত্যেকটি ধর্মকে সত্য বললেন। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মকেই প্রত্যেককে নিষ্ঠার সঙ্গে ধরতে হবে, অন্য সব ধর্মকে অন্যদের জন্য সত্য বলে শ্রদ্ধা করতে হবে। অন্যদের ধর্মান্তরিত করে নিজের ধর্মের আওতায় আনাই সব বিদ্বেষের মূল। সুতরাং শ্রীরামকৃষ্ণ হিন্দুকে ‘বেটার হিন্দু’, খ্রিস্টানকে ‘বেটার খ্রিস্টান’, মুসলমানকে ‘বেটার মুসলমান’, বৈষ্ণবকে ‘বেটার বৈষ্ণব’— হতে বলছেন। কেমন করে? নিজের মতে একশো শতাংশ নিষ্ঠা রেখে। অন্যের মতগুলিকে শ্রদ্ধা জানানোই যথার্থ ধর্মপ্রচার। ধর্মপ্রচার মানে নিজস্ব ধর্মমতের অনুগামীদের সংখ্যা বাড়ানো নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর তখন স্থূলে নেই। পুরীধামে স্বামী প্রেমানন্দ কোনও এক সন্ধ্যায় এক খ্রিস্টান পাদরির ধর্মসভা ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন লোকজন নিয়ে গিয়ে মহাসংকীর্তন শুরু করে। সেই রাতে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখা দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন— এ তুই কী করলি? ও তো আমারই কথা প্রচার করছিল। খ্রিস্ট আর আমি কি আলাদা? কাল তুই তার কাছে ক্ষমা চাইবি, আর তার ধর্মসভার বন্দোবস্ত করে দিয়ে অন্যায়ের প্রতিকার করবি।

শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তেরও এই দায়। তাঁদের হাতেই সর্বধর্ম সুরক্ষিত থাকবে। এত বড় দায় তাঁদের মাথায় যে রয়েছে, তা তাঁরা যেন বোঝেন।

লেখক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর সম্পাদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE