আজকাল পাড়ায় পাড়ায় ২০-২০ ম্যাচ। টেস্ট দেখার ধৈর্য নেই কারও। হাজার হাজার ওয়াটের আলো এসে পড়ে দু’পক্ষের গায়ে। তাদের ঘিরেই গ্যালারির ক্ষুধা নিবৃত্তি। হবু ছাত্রনেতা, লোকাল ট্রেনের তাসপার্টি, বিবেকপূর্ণ স্কুলমাস্টার, সবজান্তা সাংবাদিক থেকে প্রাক্তন গায়ক, টেকস্যাভি পুলিশ, প্রোফাইলে ট্যাগ লাগানো অ্যাডভোকেট, হিন্দু খত্রে মে হ্যায় গ্যাং থেকে হিজাবে মুখ ঢাকা প্রগতিশীল মোল্লা, লাল-সবুজ-গেরুয়া, ইস্ট-মোহন— আমরা সবাই দর্শক।
একরত্তি মেয়ের উপর করুণার লালা ঝরিয়ে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে ব্যস্ত এক দল। আর এক দল দুই শিক্ষককে শাস্তিদানের ভার কাঁধে তুলে নিয়ে বিধান দিচ্ছে: ‘লিনচ্ দেম, হ্যাং দেম’, ‘শয়তানদের গায়ে আগুন জ্বালাই’, ‘পিটিয়ে মেরে ফেলা হোক’, ‘রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে নুন ছিটিয়ে...’ এটাই আমাদের সাধের ‘নিউ ইন্ডিয়া’। জনরোষের নামে শিক্ষিত অংশের মনের ভাব-ভাষাও যেখানে হিংস্র, অসভ্য, অবিবেচক।
এই ‘নিউ ইন্ডিয়া’ মোটেও কোনও নতুন ঘটনা নয়। আদালত এক ‘জঙ্গি’কে ফাঁসিতে ঝোলালে এ দেশের ‘সমাজ-বিবেক’ নিঃসংশয় সন্তুষ্টিতে তৃপ্ত হয়। ‘সন্দেহভাজন’ কেউ ধরা পড়লেই গ্যালারির পাবলিকের কাছে তিনি ‘জঙ্গি’। ‘অভিযুক্ত’ আর ‘অপরাধী’র মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান, কে শোনে সে কথা! ‘পাবলিক সব জানতি হ্যায়’। তাই অভিজাত স্কুলে শিশু নির্যাতনে অভিযুক্তই হোক বা কলকাতায় ধরা পড়া ‘জঙ্গি’, গ্যালারি থেকে একই দাওয়াই: ‘জ্যান্ত জ্বালিয়ে দাও’, ‘দেখামাত্র গুলি করো’, ‘রাস্তায় ফেলে জবাই করো’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
অথচ সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট বলছে, শুধু মার্কিন মুলুকেই ২০১১ সালে প্রতি সপ্তাহে তিন জন করে দোষী সাব্যস্ত নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হয়েছেন। তাঁদের কেউ ৫০ বছর, কেউ বা ৩৫ বছর জেল খেটেছেন। তা-ও সাজা ঘোষণার হারে সে দেশ আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। সেখানে ভারতে বিচার শেষে সাজা হওয়ার গড় ১৪.৯% (জঙ্গি কার্যকলাপ), ৬.২% (খুন-খুনের চেষ্টা), ৪.৮% (শ্লীলতাহানি), ২০০১ সালের এই হিসেব যে খুব একটা পাল্টেছে, তা কেউই জোর গলায় বলতে পারেন না। ধর্ষণ মামলায় শুধু দিল্লিতেই ২০১৫ সাল থেকে ৭৫০০ ডিএনএ টেস্টের ফল মেলা বাকি আছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে যে বিপুলসংখ্যক নিরপরাধ ব্যক্তির গোটা জীবনটাই জেলে কাটছে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। কিন্তু তথ্যে নয়, পাবলিকের সায় আবেগে। আর তার ‘আউটরেজ’ও বরাবরই ‘সিলেক্টিভ’। কোন আঞ্জুম হাবিব, কোন মকবুল শাহ, ছত্তীসগঢ়ের কোন আদিবাসীর বিনা অপরাধে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো জেলেই কাটল, তা নিয়ে এই পাবলিকের মাথাব্যথা নেই।
কই, পুরুলিয়ার কোন অজ পাড়া গাঁয়ের শবর শিশুকন্যার উপরে এমন নির্যাতনে তার তো কোনও ‘বিকার’ দেখা যায় না। দু’দিন আগে উত্তরবঙ্গের এক নাম না জানা গ্রামে যে মেয়েটা টিউশন থেকে ফেরার পথে ধর্ষিত হল, তার খবর তো এই পাবলিক রাখে না? গ্রাম থেকে কলেজে পড়তে আসা যে আদিবাসী মেয়ে মডেলিংকে পেশা করলেন, তাঁর শরীরে পোশাকের পরিমাণ নিয়ে টিটকারি মারা ‘ট্রোল’দের বিরুদ্ধে তো সরব হয় না?
বেশি মুশকিল হচ্ছে তাঁদের নিয়ে, এই আপনি-আমি, যারা জনতার এই রোষটাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নিয়েছি। আমাদের কাছে রায়া সরকারের লিস্টের মতোই ‘স্বাভাবিক’ এই অভিযুক্তদেরও ‘পাবলিক শেমিং’। আমাদের এই ‘স্বাভাবিক’ দুনিয়ায় গ্যালারির ‘খাপ পঞ্চায়েত’ই শেষ কথা। দেশের আইনকানুন, নীতি, নৈতিকতাকে তুড়ি মেরে যে কোনও মুহূর্তে যে কারও গর্দান চলে যেতে পারে। আপনি কখন ‘রাইট’ আর কখন ‘রং’— সব কিছুই এই পাবলিক ঠিক করে দেবে। আর আপনি জনতার রোষের দোহাই দিয়ে স্বাভাবিকতার মুখোশ পরে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে মজা নেবেন। গ্যালারির রোষে প্রাণ যাবে বেচারা পেহলু খানের। তখন কিন্তু পাবলিক কিছু জানে না। সব দায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের। সমস্বরে গ্যালারি বলবে, ‘স্বাভাবিক’!
আর পরের টি-২০ শুরুর আগেই পাবলিক সব ভুলে যাবে। এই পাবলিকের বিস্মৃতিটাও ‘সিলেক্টিভ’। তারা এ দেশে মুঘলদের অবদানের কথা ভুলতে চায়। ভুলতে চায় গাঁধী, নেহরুকেও। আজকের পানসারে-কালবুর্গি-গৌরীদেরও। এই পাবলিকের স্মৃতিতে বড় বেশি টাটকা আওরঙ্গজেব-আলাউদ্দিন-টিপুর ‘অত্যাচার’, রাম আর গড্সের মন্দির। না খেতে পাওয়া পাড়ারই এক দশ বছরের কিশোরীর ভিনরাজ্যে পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ে তাদের কোনও ‘আউটরেজ’ নেই। উল্টে এই পাবলিকই অধিকার ছিনিয়ে নেয় হাদিয়াদের— পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার, স্বাধীনতার। ‘আউটরেজ’ কোথায়? আসলে এই পাবলিকের প্রজাতন্ত্র টিভির সেটে, সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রুপে আর দেওয়ালেই সীমাবদ্ধ। ‘দেশ’ তাদের কাছে পৌঁছয়নি, তারাও ‘দেশে’র কাছে। এই দেশ কি কেবল চোখের বদলে চোখ উপড়ে নিতে চাওয়া এই পাবলিকেরই? এই পাবলিক জানেও না, “তুমি আমি কি দেশ?” পরিবর্তন চাইলে সবার আগে মনের অন্দরে ঢুকে এই বাছাই করা ক্ষোভ, বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করুন।
আর অবশ্যই জেনে রাখুন: “আমরা সর্বপ্রকারে সকলের সংস্রব বাঁচাইয়া অতি বিশুদ্ধভাবে স্বতন্ত্র থাকিব, এই বলিয়া যদি গৌরব করি এবং যদি মনে করি এই গৌরবকেই আমাদের বংশপরম্পরায় চিরন্তন করিয়া রাখিবার ভার আমাদের ইতিহাস গ্রহণ করিয়াছে, যদি মনে করি আমাদের ধর্ম কেবলমাত্র আমাদেরই, আমাদের আচার বিশেষভাবে আমাদেরই, আমাদের পূজাক্ষেত্রে আর-কেহ পদার্পণ করিবে না, আমাদের জ্ঞান কেবল আমাদেরই লৌহপেটকে আবদ্ধ থাকিবে, তবে না জানিয়া আমরা এই কথাই বলি যে, বিশ্বসমাজে আমাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হইয়া আছে— এক্ষণে তাহারই জন্য আত্মরচিত কারাগারে অপেক্ষা করিতেছি।”
সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy