বিরোধী নয়, সমর্থক
অচিন চক্রবর্তী পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব তাত্ত্বিক নির্মাণের ওপর নিজেই নির্ভর করতে পারেননি (শিক্ষা এবং ছাঁকনি-দর্শন, ১৪-৯)। তিনি শ্লেষোক্তি করেছেন—‘রামার ছেলে ফেল না করলে আমার ছেলের কীর্তিটি ম্লান হয়ে যায় যে।’ আরও লিখছেন, ‘একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন, যাঁরা পাশ-ফেলের পক্ষে, সাধারণত তাঁদের ছেলেমেয়েদের ফেল করার সম্ভাবনা কম। পাশ-ফেল থাকা না-থাকার সঙ্গে তাঁদের শিক্ষার্জনের সম্পর্ক ক্ষীণ।’
চোখের সামনেই বহু রথী-মহারথী তথা বিপ্লববাগীশকে দেখেছি, যাঁরা নিজের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের গেটে পৌঁছে দিয়ে স্কুল-মোড়ে অনুষ্ঠিত পার্টির পথসভায় ইংরেজি ও পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার সমর্থনে বক্তৃতা করছেন! রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখদের জন্য দরদ একেবারে উপচে পড়ছে। এই ভাষণবাজদেরই অনেকে বাংরেজি স্কুল খুলে শিক্ষাব্যবসাও চালাচ্ছেন চুটিয়ে। ফলে যে কথা তিনি সরকারি শিক্ষানীতির বিরোধীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন (পাশ-ফেল থাকা না থাকার সঙ্গে তাঁদের শিক্ষার্জনের সম্পর্ক ক্ষীণ), সেটি শিক্ষানীতির সমর্থকদের ক্ষেত্রেই শুধু প্রযোজ্য।
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
দু’রকম নাগরিক
অচিন চক্রবর্তী ঠিকই বলেছেন, কোন কোন ঘাটতিগুলো এখনও শিক্ষার্জনে বাধা সৃষ্টি করছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারত। গেল না। সত্যই আমাদের দেশে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে নানা ঘাটতি আছে। শিক্ষকরা বার বার দাবি করলেও তা পূরণ করা হচ্ছে না। কিন্তু পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনাকেই গুণগত মানের খামতির অব্যর্থ ওষুধ বিবেচনা করা হল— এ কথা ঠিক নয়। শিক্ষার মানের অবনতি রুখতে পাশ-ফেল চালু করা দরকার ঠিকই, কিন্তু সেটাই একমাত্র সমাধান নয়— এ কথা যাঁরা পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনতে চান, তাঁরাও বলেন। বিভিন্ন সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, পাশ-ফেল না থাকায় শিক্ষার অবনতি হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, ‘যারা পাশ করতে পারল না, তাদের একই শ্রেণিতে আটকে রাখলে তারা শিখবে বেশি— এ তত্ত্বের সপক্ষে তেমন জোরালো তথ্যপ্রমাণ নেই।’ তথ্যপ্রমাণ যদি না-ও থাকে, তা হলেও এর পক্ষে জোরালো যুক্তি আছে। কোনও ছাত্র যে শ্রেণিতে পড়ে, সেই শ্রেণির মান অর্জন না করেই যদি সে উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়, তা হলে স্বভাবতই সে উচ্চতর শ্রেণির পাঠ গ্রহণ করতে অপারগ হবে। ফলে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষার আঙিনা থেকে সরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। তাই ফেল করা ছাত্রকে সেই শ্রেণিতে রেখে দিয়ে তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার, যাতে সে সেই মান অর্জনের সুযোগ পায়। এখন তো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল নেই; তা হলে যত ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকে ভর্তি হয়, তার প্রায় অর্ধেক মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই পড়া ছেড়ে দেয় কেন?
কারণ, অষ্টম শ্রেণির মান অর্জন না করেই যে সব ছাত্রছাত্রী নবম শ্রেণিতে গেল, তারা স্বাভাবিক কারণেই নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষা গ্রহণ করতে অপারগ। আর একটা বড় কারণ, দারিদ্র। সংসারের ব্যয় সংকুলানের জন্য গরিব বাবা-মা সন্তানদের কাজে লাগিয়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে ড্রপআউটের সঙ্গে পাশ-ফেলের সম্পর্ক আছে, এ কথা বলার যুক্তি নেই। বরং পাশ-ফেল না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, নিজেদের মান উন্নত করার জন্য তাদের উদ্যোগ মার খায়। শিক্ষকদেরও বোঝার উপায় থাকে না ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের পড়ানো কতখানি গ্রহণ করতে পারল এবং কার দিকে নজর দেওয়া দরকার। এতে শিক্ষকদের উদ্যমও নষ্ট হয়।
তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষার অধিকার আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতির প্রবর্তন।... তবে, প্রয়োগের দিক থেকে বাস্তব অসুবিধাগুলি নিয়ে চর্চা হতে পারত। হল না।’ এ কথা মানতে পারছি না। এ নিয়েও নানা আলোচনা হয়েছে, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার শিক্ষার অধিকার আইন চালু করে দিলেও সেই আইনে যে পরিকাঠামোর কথা বলা হয়েছিল, তার প্রায় কিছুই রূপায়ণ করেনি।
‘যারা পাশফেলের পক্ষে, সাধারণত তাঁদের ছেলেমেয়েদের ফেল করার সম্ভাবনা কম।’— এই মন্তব্যের সঙ্গেও একমত নই। পাশ-ফেলের প্রয়োজনীয়তা সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে আছে। কারণ সেখানে পড়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তানরা। এই সব বিদ্যালয়ে পাশ-ফেল না থাকলেও বেসরকারি বিদ্যালয়ে আছে। কিন্তু সে সব স্কুলে অনেক বেশি ফি দিয়ে পড়তে হয়। দরিদ্র-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের সে সব স্কুলে পড়ার সামর্থ্য নেই। উচ্চশিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পড়ে। এ ভাবে দু’ধরনের নাগরিক তৈরি হচ্ছে, যা আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রদীপকুমার দত্ত অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ
সহজ উত্তরণ?
অচিন চক্রবর্তী যে যুক্তিগুলি উত্থাপন করেছেন, তাতে গোটা বিষয়টি স্পষ্ট হল না। যেমন, পরীক্ষার আগে প্রাণপণে উদ্যোগ নেওয়া। আমাদের দেশে পারিবারিক অনটনের কারণে বহু ছাত্রই শিক্ষার নানা স্তরে ‘শিক্ষা’ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়মিত অনুশীলনের প্রাথমিক শর্তটি পূরণ করতে পারে না। স্কুলে যাওয়াই সম্ভব হয় না একটা বিরাট অংশের ছাত্রছাত্রীর। কিন্তু পরীক্ষা প্রথাটি থাকলে ছাত্র নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়। এটাকে চাপ বলেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, আবার একটা ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাও বলা যেতে পারে। অনুশীলন না করে সহজে উত্তরণ করিয়ে দেওয়ায় দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারটি গৌণ হয়ে যায় না কি?
তর্কের খাতিরে একটা মডেল ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতেই পারে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে বাস্তব ও মডেলের মধ্যে একটা ফাঁক থাকে। প্রয়োগ ও সাফল্যের সম্ভাব্য দিকগুলি বিচার করলে মডেলটি বাস্তবে আদৌ রূপায়িত করা যাবে কি না, সেগুলো তো বিচার করতে হবে। আজকের দৃষ্টিতে যে মডেল ব্যবস্থার কথা ভাবছি, পাশ-ফেল প্রথা তার একটি মধ্যবর্তী ব্যবস্থা। যাঁরা ধর্মঘট করছেন বা সমান্তরাল ভাবে পাশ-ফেল রেখে প্রাথমিক স্তরে একটা বেসরকারি পরীক্ষাব্যবস্থা চালাচ্ছেন, তাঁদের মতামতে আসলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই বোধহয় মুখ্য।
আচ্ছা স্কুল-কলেজে না হয় উঠিয়ে দিলাম। কিন্তু পাশ-ফেল তো আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বহু-র মধ্য থেকে কর্মদক্ষ বা বিষয়ে দক্ষকে খোঁজা তো চলছে ওই নিয়মেই। তা তো বাদ দিচ্ছি না। ২৩ লক্ষ থেকে ৩৬৮ যখন খুঁজছি, টেট বা জয়েন্ট ইত্যাদিতে কি এই প্রথা বাদ দিচ্ছি?
শিক্ষার বিভিন্ন উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে এক দিকে কর্ম-নিপুণতা এবং অন্য দিকে জ্ঞান-জগতে অবাধ বিচরণের দক্ষতা। এই দুটিরই জন্ম দিতে হবে। জন্ম দিতে হবে সামাজিক দায়িত্ববোধ। কিন্তু ঘটনা হল, আমরা সবাই সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষাকে রুজিরোজগারের দক্ষতা অর্জনের বিষয় হিসেবে দেখছি। শিশু কি কেবল নিপুণ কর্মকুশলী প্রশাসক বা বুদ্ধির অনুশীলকযন্ত্রে পরিণত হবে? হৃদয়বৃত্তির অনুশীলন ও দায়িত্ববোধ থাকবে এ সবের বাইরে? যে জ্ঞান ও যুক্তিবোধ আমাদের বুদ্ধি ও হৃদয়কে যুক্ত করে সমৃদ্ধ করল, তারই ধারাবাহিকতার বাহক হিসেবে কি শিশু গড়ে উঠবে না? সচেতন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে উত্তরণের বিষয়টিকে বাদ দিয়ে তা কি সম্ভব?
সাম্প্রতিক স্কুলে পাশ-ফেল থাকল বা না থাকল, তা নিয়ে আর অভিভাবকেরা ভাবছেন না! ধরেই নিয়েছেন থাকুক আর না থাকুক, রাজস্থানের কোটা বা এখানের কোনও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পাশ-ফেলের বেড়াজালেই কঠোর শৃঙ্খলায় পুনঃপুন অনুশীলনের মধ্যেই দক্ষতা অর্জন করিয়ে নেবেন। রামা কৈবর্ত যেখানেই ছিল সেখানেই থাকবে।
মহীদাস ভট্টাচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান শাখা
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy