Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

লাভ জেহাদ: শিকার মেয়েরাই

আসলে মেয়েদের শিখণ্ডী খাড়া করে সংখ্যাগুরুর ধর্ম তার ‘অস্তিত্বের সংকট’-এর অজুহাতে পরিবার, রাজনীতি, রাষ্ট্রের মাধ্যমে পিতৃতন্ত্রের চিরাচরিত বহুমাত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখে চলে।

সোহিনী মজুমদার
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

২০০৮ সালের আগে ‘লাভ জেহাদ’ (শুরুতে ছিল ‘রোমিয়ো জেহাদ’) শব্দবন্ধটির এত পরিচিতি ছিল না। ২০০৯ সালে প্রথম কেরল ক্যাথলিক বিশপ কাউন্সিল দাবি করে, এই প্রক্রিয়ায় ৪,৫০০ মেয়েকে টার্গেট করা হয়েছে। ওই অভিযোগ উঠতেই হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি দাবি করে, কর্নাটকের ৩০ হাজার মেয়েকে ইতিমধ্যেই ধর্মান্তরিত করা হয়ে গিয়েছে। নয়া এই শব্দবন্ধ এক ধরনের বিচারবিভাগীয় মান্যতা পেয়ে যায়, যখন কেরল হাইকোর্টের এক বিচারপতি পুলিশকে গোটা বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দেন। অথচ দুই রাজ্যেরই তদন্তকারী সংস্থা তদন্তের শেষে এই অভিযোগের সারবত্তা খুঁজে পায়নি। প্রতি ক্ষেত্রেই ভিন্‌ ধর্মের ছেলের প্রেমে পড়ায় পরিবারের চাপে মেয়েটিকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। ভুল প্রমাণিত হলেও গোটা বিতর্কটা হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে রসদ তুলে দেয়।

আসলে মেয়েদের শিখণ্ডী খাড়া করে সংখ্যাগুরুর ধর্ম তার ‘অস্তিত্বের সংকট’-এর অজুহাতে পরিবার, রাজনীতি, রাষ্ট্রের মাধ্যমে পিতৃতন্ত্রের চিরাচরিত বহুমাত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখে চলে। মেরঠের মাদ্রাসার হিন্দু শিক্ষিকাকে গণধর্ষণ ও জোর করে ধর্মান্তরকরণের অভিযোগে প্রেমের ফাঁদে ফেলার কোনও গল্পই ছিল না। তবু এতে ‘লাভ জেহাদ’-এর জোর ষড়যন্ত্র খুঁজে পান গোরক্ষপুরের তৎকালীন বিজেপি সাংসদ, এখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। উপনির্বাচনের প্রচারে তিনি বলেন, “ওরা আমাদের এক জন মেয়েকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করলে আমরা ওদের ১০০ মেয়েকে হিন্দুত্বে ধর্মান্তরিত করব।”

আসলে এই ‘লাভ জেহাদ’ বিতর্কে সব থেকে বড় ‘ভিক্টিম’ মেয়েরাই। সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাধীন মতামতের গুরুত্বই এখানে অর্থহীন। প্রথাবিরুদ্ধ পাত্র নির্বাচনের মাশুল হিসেবে, হয় সে সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়, নয়তো কখনও ধর্ষিতার তকমা দিয়ে কখনও বা জোর করে ধর্মান্তরকরণের তত্ত্ব খাড়া করে, তার স্বাধীন-সত্তার অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করা হয়। হাদিয়ার মামলায় কেরল হাইকোর্ট বলেই দেয়, ২০-৩০ বছর বয়সি অবিবাহিত মেয়েরা ‘অত্যন্ত অসুরক্ষিত’। যে কেউ তাঁদের ক্ষেত্রে যে কোনও রকম সুযোগ নিতে পারে। তাই যত দিন না তাঁদের ‘যথাযথ’ ভাবে বিয়ে হচ্ছে, তত দিন বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানই তাঁদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু এই নিরাপত্তার তোড়জোড় কি সত্যিই মেয়েদের কথা ভেবে? না কি রাষ্ট্র আসলে পুরুষতন্ত্রের ‘প্যারানয়া’কেই মান্যতা দিচ্ছে?

এই সমাজে মেয়েরা কখনওই কোনও সম্প্রদায়ের মৌল সদস্য নয়, পুরুষ সদস্যের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে ওই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয় মাত্র। এবং পূর্বনির্ধারিত নিয়ম, ভূমিকা, অনুশীলন, আচারমাফিক ওই সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে, তাকে সুরক্ষার পুরস্কার দেওয়া হয়। অন্যথায় জোটে পিতৃতন্ত্রের বহুমুখী দমনপীড়ন। ‘লাভ জেহাদ’ তত্ত্বের আড়ালে আসল সংকট কিন্তু ঠিক এই জায়গাতেই। যে কোনও সামাজিক নির্বাচনের একমাত্র অধিকার পুরুষের। এই প্রতিষ্ঠিত, থাকবন্দি প্রথার কাছে একটা বড় ‘বিপদ’ এই মেয়েরা, যাঁরা স্বেচ্ছায় সামাজিক শর্তের বাইরে সঙ্গী নির্বাচন করছেন। কারণ ‘হেটরোনর্ম্যাটিভ’ পিতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষুদ্রতম একক, ‘দাম্পত্য-সম্পর্ক’। ফলে তার মধ্যে যে কোনও রকম বিরুদ্ধাচরণ, বিয়ের প্রতিষ্ঠান তথা আইনসিদ্ধ পরিবারের কাঠামোকে ভেঙে পিতৃতন্ত্রের ভিত নড়িয়ে দিতে পারে। তাই ভয় পায় ক্যাথলিক সোসাইটি, তাই ভয় পায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। ভয় পায় অকাল তখ্‌ত। একই ভয় কট্টর ইসলামি সংগঠনগুলোর। এবং রাষ্ট্রেরও।

নিবেদিতা মেনন-এর মতে (‘স্টেট/ জেন্ডার/ কম্যুনিটি: সিটিজেনশিপ ইন কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়া’, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, ৩১-১-৯৮), ধর্মীয় নিয়মাবলির প্যাঁচে পরিবারের ভেতর মেয়েদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে, তার পর তাকে ‘সেকুলার ওয়ে অব লাইফ’ আখ্যা দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা করে আরএসএস-এর মতো সংগঠনগুলো। সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ হিসেবে কখনও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবিকা সমিতি ‘সুশীলার উপাখ্যান’ তৈরিতে উঠে পড়ে লাগছে, কখনও ‘লাভ ত্রিশূল’ শিবির পাল্টা জেহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোহন ভাগবতেরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘লাভ জেহাদ’-এর কবল থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে বাবা-মায়ের ‘সুসংস্কার’-এও কাজ না হলে এ ব্যাপারে থানা-পুলিশ করতেই হবে।

২০১৫ সালেই কোবরাপোস্ট এবং গুলেল ডট কম-এর মিলিত ‘স্টিং অপারেশন’ দেখিয়েছিল কী ভাবে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপির নেতা-সাংসদ-মন্ত্রী থেকে পুলিশ-প্রশাসন, আইনজীবীদের একাংশও এই ‘লাভ জেহাদ’-এর মিথকে প্রতিষ্ঠা দিতে তৎপর। হাদিয়ার মামলা প্রসঙ্গে ‘লাভ জেহাদ’কে একপ্রকার মান্যতা দিয়ে ‘রাষ্ট্র’ও কি এই ‘কাল্পনিক বিপন্নতা’র প্রকল্পকেই খুব সরাসরি ইন্ধন দিল না?

আজ গালিব বেঁচে থাকলে সেই রাষ্ট্রের কান ধরে স্মরণ করিয়ে দিতে পারতেন, ‘ইশ্ক পর জোর নহী, ইয়েহ্ ওহ্ আতিশ গালিব/ কে লাগায়ে না লাগে, ঔর বুঝায়ে না বনে’। (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE