ব ছর তিন হল, কলকাতায় রাজপাট খুলেছে লাক্সারি-ট্যাক্সি পরিষেবা। তাতে ঢুকে গেলেই এসির বাতাস, আতরের সুগন্ধ, মৃদুমন্দ বাজনা। যেন চাঁদ এগোল মেঘের ভেলায় ভেসে। পথশ্রম পরাভূত।
এই পরিবহণ-ব্যবস্থার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল আমেরিকায়। তার পর প্রতিটি মহাদেশের প্রায় প্রতিটি মেট্রো শহরে পা রেখেছে নানা অ্যাপ-ক্যাব সংস্থা। বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই ঘুরে কলকাতা, এবং বাকিটা নিখাদ ইতিহাস।
অন্যতম কারণ জীর্ণ গণপরিবহণ। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে কলকাতার জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ। গাড়ির মালিক শতকরা প্রায় ৪ জন। বাকিরা অ-পর্যাপ্ত বাস, মেট্রো, অটো, রিকশর দুর্ভোগকেই দুর্ভাগ্য মেনেছেন। একটু শ্রম বাঁচাতে চেষ্টা করলে হলুদ ট্যাক্সির জুলুমের শিকার হন।
এই বিশাল ফাঁকটায় জাঁকিয়ে বসেছে অ্যাপ-ক্যাব। ট্যাক্সির থেকে সামান্য বেশি দিলে যদি ঠান্ডা গাড়ি আসে, বায়নাক্কা ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, মন্দ কী। ‘প্রিমিয়াম সার্ভিস’ বলে বিশ-তিরিশ টাকা যদি বেশি দাবি করে, খুব অন্যায়? এই ভূভাগে ভদ্রতা, নিরাপত্তা তো পয়সা দিয়েই কিনতে হয়।
অ্যাপক্যাব আসায় যাতায়াতের সমস্যা মিটল সুখী মধ্যবিত্তের, আর সমাজের বিরাট অংশের কর্মসংস্থান হল। এক শহরে এ ব্যবস্থা চালু হলে, আশপাশের জেলা, পাশের রাজ্যেরও কিছু মানুষ খেয়েপরে বাঁচলেন। মাত্র গত বছরই, দেশের মোট ২৯টি শহরে, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার আয়ত্তে থাকা ক্যাবচালকের সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের আশেপাশে। আর একটি সংস্থা ছড়িয়ে আছে ১০২ শহরে, গাড়ির সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ (অটো নিয়ে)।
হলুদ ট্যাক্সি ক্রমেই বিরল প্রজাতি। ২০১৪ সালে ৫০০০ হলুদ ট্যাক্সি নামাতে চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল পরিবহণ দফতর। পরের তিন বছরে এই এক ফোনে ট্যাক্সি এত জনপ্রিয় হয়েছে যে, এখনও মিটার-ট্যাক্সির অর্ধেক পারমিট বিলিই হয়নি। লাইন বাড়ছে লাক্সারি ট্যাক্সির পারমিটের। ফারাক যে দু’তিন হাজার টাকার। অথচ, আয়ের সুযোগ বেশি।
গোটা বিশ্বে, মার্কিন মুলুকের বাইরে, ভারতই এই শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার। এই শহরে উত্থানও গোটা দেশে সব থেকে বেশি। এবং, সেটাই এঁদের সমস্যার জায়গা। এত গাড়ি রাস্তায় নামানো, চালক টানতে এত স্মার্টফোন ও অন্যান্য সুবিধের বন্দোবস্ত— বিনিয়োগ অত্যধিক। সে অনুপাতে মুনাফা নাকি নেই। সংস্থা লোকসানে পড়ছে, উৎকর্ষ রাখতে পারছে না।
চাহিদা ও শান্তি, জীবনের নিয়মেই ব্যস্তানুপাতী। আর বাণিজ্যগুরুরা বলেন, পরিমাণ ও গুণমানের বিরোধ চিরকালীন। মনোযোগের বা কাজের ক্ষেত্রটা অস্বাভাবিক রকমের ছড়িয়ে গেলে, সব দিকে সমান নজর দেওয়া, সর্বত্র সমান ‘পারফর্ম’ করা অসম্ভব।
এ ব্যবসাও আয়তনে এত বেড়েছে, তার প্রতিটি অংশকে ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণমান বজায় রাখাই যুদ্ধ। ২০১৪ সালেই, আন্তর্জাতিক অ্যাপক্যাব সংস্থাটি ‘বেটার বিজনেস বুরো’র সমীক্ষায় ‘এফ’ পেয়েছে। কারণ দর্শানো হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া, অভিযোগ দায়রায় অবহেলা। ভারতের মতো দেশে, যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষা রাখতেও হিমশিম সংস্থা। মেয়েদের অসম্মান, যাত্রীকে মারধর, রুট নিয়ে বচসা, বেহাল গাড়ি খাটানো— নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে উপমহাদেশে গণপরিবহণের বিরুদ্ধে বারে বারে ওঠা অভিযোগগুলো।
স্মার্টফোনে দড় ঝাঁ-চকচকে নাগরিকই এ সব অ্যাপে প্রতি দিন আনকোরা কোনও প্রযুক্তি খুঁজে পান। সে ক্ষেত্রে, চালকদের অপারগতাকেই বা দোষ কেন? আগে, তিনি হয়তো ফোনের মাধ্যমে মেসেজ-কলটুকু সারতে আর প্রাথমিক কিছু বিনোদন পেতে অভ্যস্ত ছিলেন। রাতারাতি তাঁকে, নিয়ত পরিবর্তনশীল জটিল ডিজিটাল হয়ে উঠতে বললে তিনি হোঁচট তো খাবেনই। একটি সংস্থার দাবি, গাড়ি রাস্তায় নামানোর আগে তারা চালককে প্রশিক্ষণ দেয়। সেটাকে মাসব্যাপী, কঠিন কম্যান্ডো-ট্রেনিং মনে করলে ধাক্কা খেতে হয়। এই বিশাল জনসমুদ্রের জন্য তেমন কোনও আয়োজন রাখলে পড়তায় পোষাবে না। এটা আসলে কুড়ি মিনিটের সেশন। ম্যাপের সঙ্গে পরিচয় করানো হয়, যাত্রী-সৌজন্য রাখতে বলা হয়। আর যা-ই হোক, কুড়ি মিনিটে ‘সফ্ট স্কিল’ শেখানো অন্তত অসম্ভব।
প্রথম দিকে, গ্রাহকদের হাসিটি যেমন চওড়া ছিল, চালকদের লক্ষ্মীর ঘড়াটাও উপচে পড়ছিল। কিন্তু এখন এত গাড়ি রাস্তায়, ভাগীদার বেড়ে চলেছে, হাতে মিলছে অনেক কম। মুনাফার প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে গাড়ির নিলাম (সার্জ) ডেকে। গ্রাহকদেরও নালিশের বন্যা। ২০১৪-য় সংস্থা অভিযোগের উত্তর দিত তৎক্ষণাৎ। ’১৫-য় লাগত দশ মিনিট, ’১৬-য় এক দিন, ’১৭-য় দশ দিন। ভারচুয়াল চোখে লাইনটা দেখে ভয় লাগে।
এতখানি জনপ্রিয়তায় উৎসাহ পেয়ে, আন্তর্জাতিক সংস্থাটি এখানকার পরিষেবায় যোগ করতে চেয়েছিল মার্সিডিজ চড়ার সুযোগ। সে প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই ভূখণ্ডে বিলাসের নয়, সু-পরিবহণের দরকার। যার দাম হবে, প্রতি দিন নিজের গাড়ি রাখার খরচের থেকে কম। যা ছিল আরাম-যান, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুশকিল আসান। কাজে লাগছে, এই ঢের। তার হতশ্রী দশা নিয়ে নিন্দে করে লাভ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy