প শ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে আছেন, এর তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়েছে গত এক দশক ধরে। দশ বছর আগে প্রকাশিত সাচার কমিটি রিপোর্ট বা সম্প্রতি প্রকাশিত ‘লিভিং রিয়্যালিটি অব মুসলিমস ইন বেঙ্গল’ রিপোর্টে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার নানা কারণের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কাজের সুযোেগর ক্ষেত্রে বঞ্চনার ছবি উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, মুসলমানরা রাজ্যের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হওয়া সত্ত্বেও, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন সরকারি চাকরিতে, উচ্চশিক্ষায় ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে তাঁদের উপস্থিতি রীতিমত কম।
এই পরিস্থিতির একটা গভীর সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে। প্রসঙ্গত, সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘স্বাধীনতার পর ক্রমাগত অপরিচয়ের কারণে উচ্চবর্গের হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজে, বিশেষ করে কলকাতা শহরে, বাঙালি মুসলমান এক অজানা বিজাতীয় প্রাণী হয়ে গেল। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমি কোনও বাঙালি মুসলমান চিনতাম না।’ চেনা এক অধ্যাপক সখেদে স্বীকার করলেন, ‘কোনও বেলাতেই মুসলমান বন্ধু পেলাম না; স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মস্থলে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ সম্পর্কে জানার কোনও সুযোগ হয়নি’।
মুসলিম সমাজ সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই বিপুল অজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস। আর তা থেকে জন্মেছে চরম অবহেলা। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলে সামগ্রিক ভাবে হয়তো আমরা সকলেই লাভবান হতাম, মতবিনিময়ের সুযোগে তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের সম্যক ধারণা হত, এবং তাঁদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ সহজ হত।
সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে গভীর আলোচনা দরকার। কিন্তু এখানে বিশেষ নজর রাখব রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ওপর। জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাতের নিরিখে রাজনৈতিক পরিসরে— সে বিধানসভাই হোক লোকসভাই হোক— তাঁদের উপস্থিতিতে সমতার কাছাকাছি পৌঁছতেও এখনও ঢের বাকি।
একটা প্রশ্ন উঠবেই: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় আবার আলাদা করে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দরকার কেন? শাসকের মানসিকতা থেকে এ প্রশ্ন বার বারই ধেয়ে এসেছে। পরিচিতি বা ধর্মীয় জনজাতিগত মাপকাঠিতে সব কিছু বিচার করা কি সত্যিই দরকার? দরকার অবশ্যই আছে। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, অর্থাৎ হিন্দু নাগরিকরা মুসলমান সমাজকে চেনেন না, জানেন না, বোঝেন না। এতটা অপরিচয় নিয়ে তাঁরা কী ভাবে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবেন, কী ভাবে তাঁদের প্রয়োজনের কথাগুলো ওপরমহলে জানাবেন?
মুসলমান সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো গভীর ভাবে বোঝা অ-মুসলিমদের পক্ষে বেশ কঠিন। প্রথমত, মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে দূরত্ব, এবং তাঁদের সমস্যা বোঝার জন্য যে সংবেদনশীলতা প্রয়োজন, তার বড় অভাব। নিজেদের সংবেদনশীল ও উদারমনা বলে দাবি করা বাম শাসকরা সত্যিই যদি খানিক সংবেদনশীল হতেন, তা হলে স্বাধীনতার পরে এ রাজ্যের মুসলমানদের এত দুর্ভাগ্য হত না। বর্তমান সরকারের আমলেও একই অবস্থা। মুসলমান সম্প্রদায় আসলে কী চায়, এ বিষয়ে তাঁরা জানতেই চান না। যেমন গরিব বা মধ্যবিত্ত মুসলমান সরকারি টাকায় ইমাম ভাতা চায় না। চায় লেখার খাতা অর্থাৎ শিক্ষা। আর চায় কর্মসংস্থান। অথচ নীতি নির্ধারণের সময় এর প্রতিফলন দেখা যায় না।
সংবিধানে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের সংরক্ষণ থাকায় লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা বা পঞ্চায়েতগুলিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ না থাকায় রাজনীতি, আইন প্রণয়নকারী ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাগুলিতে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক নয়। এই লোকসভায় মাত্র ২২ জন সাংসদ মুসলমান।
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বিধানসভায় মুসলমান সদস্য ছিলেন ১০ শতাংশ। বিদায়ী বিধানসভায় মোট ২৯৪ সদস্যের ২০ শতাংশ মুসলমান। বিধানসভায় সদস্যসংখ্যা বাড়লেও মন্ত্রিসভায় ৪৪ মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র পাঁচ জন মুসলমান। গুরুত্বের বিচারে নগরোন্নয়ন দফতর ছাড়া বেশির ভাগ তত-গুরুপূর্ণ-নয়, এমন দফতরের দায়িত্বে রয়েছেন মুসলমান বিধায়করা।
স্বাধীনতার প্রথম কুড়ি বছর কংগ্রেস শাসনের সময় মোট বিধায়কদের মধ্যে গড়ে মাত্র ১২ শতাংশ মুসলমান ছিলেন। দেশভাগের ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের এক অংশ দেশ ত্যাগ করতে প্রায় বাধ্য হন, ফলে মুসলমান সমাজে নেতৃত্বহীনতা ও বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে মুসলমানদের বিরাট অনুপস্থিতি দেখা দেয়। এর মধ্যেও বেশ কয়েক জন শক্তিশালী মুসলমান কংগ্রেস নেতার নাম মনে করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের আমলেও হতাশাজনক ভাবে গড়ে মাত্র ১৩ শতাংশ মুসলমান বিধায়ক ছিলেন। মন্ত্রিত্বের নিরিখে অল্প কয়েক জন ছাড়া কেউই গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলাননি।
ধর্মীয় পরিচিতি বাদ দিয়ে মুসলমানদের যদি আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে, তাঁদের উন্নতির কথা ভাবা হত, তা হলে আজও এই সমাজকে এমন দুর্দশার মধ্যে থাকতে হত না। কিন্তু তাকে উন্নত করার জন্য, তার কথা বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, তাকে নেতৃত্বদানের যোগ্য করে তোলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বামফ্রন্ট সে রকম কোনও তাগিদ দেখাতে সাহস পায়নি। বাম শাসকরা রাজনৈতিক পরিসর থেকে ধর্মীয় পরিচিতিকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়ে বাস্তবকে অন্ধকারে রেখেছিলেন। সম্বিৎ ফেরে সাচার কমিটি রিপোর্টের পর। কিন্তু তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে, রাজ্যের মুসলমানরা পিছিয়ে পিছিয়ে তত দিনে পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। এমনকী, এই বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের হিসাব দেখলেই বোঝা যায়, বামফ্রন্ট অতীত থেকে শিক্ষা নিতে নারাজ।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বও একটি জনগোষ্ঠীর যে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে, তা নতুন করে বলার দরকার নেই। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি কেন এতটা অনালোচিত, বিশেষ করে মুসলমান বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে? কারণটা খুবই সহজবোধ্য, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে মুসলমানদের অংশ গ্রহণ বাড়লে উচ্চবর্ণের অহং-এ আঘাত লাগবে, আঘাত লাগবে তাদের স্বার্থেও, ক্ষমতার বৃত্ত সংকুচিত হবে। দলমতনির্বিশেষ এই পরম্পরা চলছেই। প্রতিনিধিত্ব আগের চেয়ে সামান্য বাড়লেও, ফারাক এখনও বিস্তর। নীতি নির্ধারণে মুসলমানদের যোগদান অতি সামান্য।
কার্যকর প্রতিনিধিত্ব ছাড়া যথার্থ গণতন্ত্র হয় না। ভারত নিশ্চয়ই গণতন্ত্রবর্জিত একটা দেশ হয়ে উঠতে চায় না। অনেক সমস্যা সত্ত্বেও সে গণতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরতে চায়, চেয়ে আসছে গত সাত দশক ধরে। সেই চাওয়ার সার্থকতা বহুর মধ্যে এক, একের মধ্যে বহুর উপলব্ধিতে। মুসলমান প্রতিনিধিত্বের দাবিও এ দিক দিয়ে বিবেচনা করা দরকার।
প্রতীচী ইন্সটিটিউট –এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy