প্রতীকী ছবি।
আমরা শিউরে উঠেছি। আমাদের প্রায় প্রত্যেককে এক তীব্র ঝাঁকুনির মুখে ফেলেছে ঘটনাটা। অনেকে এমনও ভাবছেন যে, চার বছরের শিশুর সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটল, তা কোনও ভাবে আমাদের শহরের পরিচয় এবং অস্তিত্বটাকে ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কারণ মনুষ্যত্ব বা মানবিকতা বা সাধারণ মূল্যবোধ হল ভূ-নিরপেক্ষ। এ শহরে সে সব বেশি থাকার কথা, অন্য শহরে কম, এমনটা নয়। কিন্তু দিনের শেষে আমরা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করছি যে, ঘটনাটার দিকে তাকানোর প্রেক্ষিত বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে একের সঙ্গে অন্যের মতামতে কিছু ফারাক থাকলেও, আমরা সকলেই সমপরিমাণ মর্মাহত। আমরা তাই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি। রাস্তাঘাটে, দোকানে-বাজারে, ট্রেনে-বাসে উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় গর্জে উঠছি, ডিপি মুছে দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এই সবই অত্যন্ত সঙ্গত। এই উষ্মা ইতিবাচকও। কিন্তু আমাদের এই তীব্র উষ্মা, এই প্রবল ক্ষোভ, এই আক্রোশ কত দিন থাকবে? যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে সমাজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া এই প্রবল জনাবেগ খুব জরুরি ছিল। কিন্তু এই প্রথম বার তো নয়। আগেও তো অনেক বার এই রকম রেগে গিয়েছি আমরা, প্রবল প্রতিক্রিয়ায় সমস্বর হয়েছিল কোনও অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত বীভৎসতার বিরুদ্ধে। আবার থিতিয়েও গিয়েছি অচিরেই। এ বারও কি সে ভাবেই স্তিমিত হয়ে যাব? যদি এ বারও স্তিমিত হয়ে যাই কোনও মৌলিক পরিবর্তনের পথ প্রস্তুত না করে, তা হলে কিন্তু একটুও এগনো হবে না আমাদের।
আরও পড়ুন
মাকে ছাড়ছে না এক মুহূর্তের জন্য
বার বার দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয় বীভৎসতা। পীড়নের যন্ত্রণা অনুভূত হয় গোটা সমাজে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দিই আমরা। তার পর কেউ কেউ আশা রাখি, এমন বীভৎসতা আর দেখতে হবে না। আমরা আশা রাখি, এ বারের অভিজ্ঞতা হয়ত উন্নততর মানবিকতায় পৌঁছে দেবে এ সমাজকে। কিন্তু আবার হানা দেয় বীভৎসতা, আবার রক্তাক্ত করে মনুষ্যত্বকে। আমরা অনুভব করি, একটুও এগতে পারিনি, কোনও উন্নততর মানবিকতায় পৌঁছইনি।
দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি স্কুলের শিশু পড়ুয়ার উপর যৌন পীড়নের খবর প্রকাশ্যে আসার পর সমাজের সব স্তর থেকে প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরেই সমস্বরে প্রতিবাদ হচ্ছে, ধিক্কার ধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু আর ক’দিন এই ধিক্কার চলবে? আস্তে আস্তে আবার তো যে যার জীবনযুদ্ধে বুঁদ হয়ে যাব। যৌন নিপীড়নের ঘটনাটা খবর হিসেবে কয়েক দিন আগ্রহের শীর্ষে থাকার পর গুরুত্ব হারাতে শুরু করবে। আমরা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের দিকে একটু চোখ রাখব। ইভাঙ্কা ট্রাম্প সত্যিই আধার কার্ড নিতে ভারতে এসেছিলেন কি না, সে নিয়ে একটু চর্চা করব। বিরাট কোহালির সেঞ্চুরির দিকে নজর ঘোরাব। এটাই নিয়ম। চাইলেও কেউ রুখতে পারব না। রোখার প্রয়োজনও নেই, জীবন থামিয়ে রাখতে আমরা চাই না, জীবন স্বাভাবিক নিয়মেই চলুক। কিন্তু দু’টো বিষয় নিশ্চিত করা হোক। প্রথমত, অপরাধীর বা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। দ্বিতীয়ত, গাফিলতি যদি থেকে থাকে অন্য কোনও পক্ষের, যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হোক তার বিরুদ্ধেও।
অভিযুক্তদের বিচার অত্যন্ত দ্রুত হওয়া জরুরি। অপরাধ প্রমাণিত হলে এমন সাজা হোক, যা ভবিষ্যতে যে কোনও অপরাধপ্রবণের বুকে আগাম আতঙ্ক জাগাবে। এমন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের জন্য প্রশাসনকে বা সরকারকে বা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে হয়ত বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হতে হবে। প্রয়োজনে তাই হোক। কিন্তু এই অন্যায়ের দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার সুনিশ্চিত করা হোক।
প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা বা উপযুক্ত সতর্কতা থাকলে যে অপরাধ ঘটতে পারে না, সে কথাও মনে রাখা জরুরি। সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ কি পড়ুয়াদের নিরাপত্তার বিষয়ে আদৌ খুব যত্নবান ছিলেন? প্রকৃত নজরদারি কি ছিল? কেন নেই পর্যাপ্ত সিসিটিভি কভারেজ? এই রকম অনেক প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। এই প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার বিষয়েও অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ স্কুল কর্তৃপক্ষ কতটা কর্তব্য পরায়ণ, তা এই প্রশ্নগুলোর জবাবেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। গাফিলতির আঁচ যদি মেলে, ঔদাসীন্য যদি প্রমাণিত হয়, তা হলে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
যে জঘন্য অপরাধের শিকার চার বছরের শিশু, আমাদের সুবৃহৎ সমাজে সে অপরাধ দৈনন্দিন ঘটনা, এমনটা নয়। কিন্তু এই ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এক বার ঘটলেই তা কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে সমাজে, সে কথা স্পষ্ট হয়ে গেল। এমন ঘটনার সাক্ষী আর হতে চাই না আমরা। দু’মাস, ছ’মাস, এক বছর বা পাঁচ বছর পরে আবার যেন মনে না হয়, একটুও এগতে পারিনি আমরা। সেটুকু নিশ্চিত করা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy