Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
অশ্বেতাঙ্গ মানুষ বিষয়ে বহু মার্কিনির অযৌক্তিক ভয় এবং ঘৃণা

শত্রু মানেই যার রং বাদামি

কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরাই এই শ্বেতাঙ্গদের প্রধান লক্ষ্য, তবু এই সন্ত্রাসবাদের যুগে মার্কিন বর্ণবিদ্বেষের কেন্দ্রে এসে গিয়েছেন মুসলিমরা— কিংবা বলা উচিত, যাঁরা মুসলিমদের মতো দেখতে সেই মানুষেরা।

বর্ণ-যুদ্ধ: বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সমাজের সংকীর্ণ রাজনীতির প্রতিবাদে মুক্তমনা নাগরিক মিছিল, শার্লটসভিল, ভার্জিনিয়া, ৮ জুলাই। ছবি: রয়টার্স

বর্ণ-যুদ্ধ: বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সমাজের সংকীর্ণ রাজনীতির প্রতিবাদে মুক্তমনা নাগরিক মিছিল, শার্লটসভিল, ভার্জিনিয়া, ৮ জুলাই। ছবি: রয়টার্স

জনম মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১১
Share: Save:

সাদা চামড়াই সেরা, এমন একটা মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাধান্য পাচ্ছে বলে আজকাল আমরা শুনছি। ‘কু ক্লুক্স ক্ল্যান’-এর মতো বর্ণবিদ্বেষী, হিংস্র গোষ্ঠীদের রাজনৈতিক জোর নাকি বাড়ছে। বলা হচ্ছে যে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসীরা লুম্পেন শ্রেণির লোক। দরিদ্র সাদা-চামড়ার এই মার্কিনিরা থাকেন গ্রামে, মস্ত আকারের ট্রাক চালান, সঙ্গে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র রাখেন। এঁরা ক্ষুব্ধ ও বিপজ্জনক। অতীতের নানা কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন— যা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের পিটিয়ে মারত, কৃষ্ণাঙ্গ-অনুরাগী শ্বেতাঙ্গদের বাগানে ক্রুশ জ্বালাত, কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদার হিংস্র বিরোধিতা করত— সেগুলোর সঙ্গে এঁরা সহমত। এঁদের শিক্ষা সামান্য, রোজগার কম, শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবির ভিত্তিতে অতি সাধারণ কোনও কাজ হয়তো জুটিয়েছেন। দেশের অর্থনীতির প্রান্তে, অস্বাস্থ্যকর কোনও পেশা থেকে যৎসামান্য আয় করেন। সম্প্রতি নানা প্রতিবাদ মিছিলে এঁরা বিরোধীদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন। দেশের অভ্যন্তরের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে এই উগ্র, মারমুখী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা একজোট হচ্ছেন, এবং মার্কিন সমাজে আরও বড় সংঘাত তৈরি করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরাই এই শ্বেতাঙ্গদের প্রধান লক্ষ্য, তবু এই সন্ত্রাসবাদের যুগে মার্কিন বর্ণবিদ্বেষের কেন্দ্রে এসে গিয়েছেন মুসলিমরা— কিংবা বলা উচিত, যাঁরা মুসলিমদের মতো দেখতে সেই মানুষেরা। আমার নিজের শহর মিশিগানের লানসিং-এ আমার নিম্নবিত্ত শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের থেকে শুনতে পাচ্ছি, তাঁদের প্রতিবেশীরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মজুত করছেন। বাদামি চামড়ার উন্মত্ত লোকজন যে কোনও দিন খতম করে দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, এই ধারণা থেকে তাঁদের এত সুরক্ষার ব্যবস্থা। যদিও ঘটনা হল, শিল্প-উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ, ক্ষয়িষ্ণু অঞ্চলে অনেক মানুষ কোনও দিন নিজের চোখে কোনও মুসলিমকে দেখেননি। তাঁরা ধরে নেন, যখন দেখবেন তখন ঠিক চিনবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাদামি চামড়ার লোকেরা তাই সহজেই শত্রু বলে চিহ্নিত হচ্ছে। সে জন্যও দক্ষিণ এশিয়ার লোকেরা খুন হয়ে যাচ্ছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের হাতে। সাদা চামড়ার মানুষদের থেকে ‘ভিন্ন’ বাদামি/মুসলিমদের আশঙ্কা থেকে উদ্ভূত আবেগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের উত্থানকে সবচেয়ে বেশি ইন্ধন জোগাচ্ছে।

কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের এই জাতীয়তাবাদ কী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রে চলে এল? সেটা বুঝতে হলে কেবল ছোট ছোট এলাকায় দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের বিশ্বাস বা ধারণার দিকে তাকালে হবে না। তাকাতে হবে ক্ষমতার বৃহত্তর নকশার দিকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের যারা ভোটার, তারা আরও বড় এক জনতার অংশ। সেই বৃহত্তর জনতার চিন্তার ভিত্তি কী? গত দেড় দশকে ‘সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধাভিযান’ (War against terror) হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনসমাজের সংস্কৃতির প্রধান প্রেক্ষিত। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে মার্কিন জনতাকে ক্রমাগত দেখানো হয়েছে এক শত্রুর ছবি, বোঝানো হয়েছে যে এই শত্রু দয়ামায়ার যোগ্য নয়, কোনও বিবেচনারও প্রয়োজন নেই। তাদের নির্যাতন করতে হবে। বোমায় উড়িয়ে দিতে হবে। বিষাক্ত ধোঁয়া ছুড়ে গর্ত থেকে বার করে খতম করতে হবে। বিশ্বের সব চাইতে বড় সেনাবাহিনী এই নির্দেশ নিয়ে এগিয়েছে। প্রথমে আফগানিস্তান, তার পর ইরাক, পাকিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, ফিলিপিন্স এবং আরও নানা দেশে ছড়িয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। শত্রু থাকতে পারে যে কোনও জায়গায়, এবং তার রং সব সময়েই বাদামি। আজ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন কি এই বাস্তবটা বাদ দেওয়া চলে?

মার্কিন সমাজে বাদামি মানুষদের উপস্থাপনা কী ভাবে করা হয়েছে, কেবল সেই প্রশ্ন করলে চলবে না। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবিদ্বেষ বুঝতে হলে দেখতে হবে, কী বিপুল সংখ্যায়, বিশাল পরিধিতে বাদামি শরীরগুলোকে ছিন্নভিন্ন করার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে হিংসার যে অধিকার দাবি করল, ইতিহাসে তার কোনও নজির মেলে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনও নির্দিষ্ট দেশের সীমায় বাঁধা রইল না। ঘোষণাই করা হল যে সেই অভিযান আন্তর্জাতিক আইনের আওতার বাইরে। এগারোই সেপ্টেম্বরের হামলার সঙ্গে ইরাকের কোনও সম্পর্কই ছিল না, এবং যুদ্ধ ঘোষণার যুক্তি-তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছিল, তবু মার্কিন সেনা সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করল ইরাককে। ইরাক ধ্বংস হয়ে গেল। পরের ক’বছরে কয়েক লক্ষ বাদামি দেহ ধ্বংস হতে দেখলেন মার্কিনিরা। তাদের নামে কী করা হচ্ছে, তা জেনেও নীরব রইলেন তাঁরা। সেই নীরবতার দাম চোকাতে হবে বইকি।

আজ যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ নিয়ে কথা উঠলে পতাকা-দোলানো নব-নাত্‌সি আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাটুকেপনাকে অতিক্রম করে চিন্তা করতে হবে। মনে করতে হবে বাগদাদের আবু ঘ্রাইব কারাগারে স্তূপীকৃত মানবদেহের কথা, সেখানে নির্বিচারে নির্যাতনের কথা। গুয়ান্তানামো এবং অন্যান্য কলঙ্কিত স্থান, যেগুলো কার্যত বিচার-বহির্ভূত বধ্যভূমি, সেখানে শিকল-বাঁধা, মুখ-ঢাকা দেহগুলোর কথা। যে সব দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, সেখানেও ড্রোন বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত অস্ত্রে জ্বলে-যাওয়া দেহগুলোর কথা। একের পর এক অশ্বেতাঙ্গ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তহীন যুদ্ধে একাধিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আটকে পড়া লক্ষ লক্ষ মানবদেহের কথা। গত ষোলো বছরে যত বাদামি দেহের উপর যত হিংসা হয়েছে, তার যোগ করলে হতবাক হতে হয়। কেউ কি চিন্তা করতে পারে, সমান সংখ্যায় শ্বেতাঙ্গের উপর সমান মাত্রায় হিংসা হয়েছে, অথচ তা নিয়ে বিবেক-তাড়িত আলোচনা হয়েছে এত সামান্য? এই হিংসা বর্ণবিদ্বেষ থেকে উদ্ভূত কি না, সে তর্ক অর্থহীন। মৃতদেহগুলিই যুক্তির জায়গা নেয়। কেন ওই দেহগুলির উপর এত বড় অন্যায়ের এত কম প্রতিবাদ?

অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্বীকার করেন, ঔপনিবেশিকতা এবং দাসত্বের জন্য তৈরি হয়েছিল যে গৃহযুদ্ধ, অস্থিরতা, হতাশা ও ক্ষুধা, তার থেকে ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার সমর্থন মিলেছিল। যে শরীরগুলো ভগ্ন, অপমানিত, বিনষ্ট, অধিকৃত এবং পরস্পর-সংঘর্ষরত, সেগুলো প্রমাণ করেছিল যে ইউরোপের লোকেরা জাতি হিসেবে সেরা। উপনিবেশের মানুষের নৈতিক বিপর্যয় তাদের দুর্বলতার আরও বড় সাক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। দেহের উপর আধিপত্য মনের কাছে ‘প্রমাণ’ তৈরি করে। আজ আমাদের স্বীকার করতে হবে যে মুসলিম বিশ্বে এই পরিস্থিতিই ফের তৈরি করেছে মার্কিনিদের সামরিক অভিযান।

ষোলো বছরের সীমাহীন, গণ্ডিহীন যুদ্ধের পরে ‘শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব’, আর সেই সঙ্গে বাদামি চামড়ার মানুষদের প্রতি এক অযৌক্তিক ভয় যে আজ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে, তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ চালানোর ফলে মার্কিন সমাজে সংকীর্ণ বিদ্বেষ আর হিংস্রতার পরিসর তৈরি হয়েছে, বিশেষত ছোট শহর, গ্রামে। শত্রু প্রবেশ করেছে অন্দরে।

কানাডার রায়ার্সন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE