Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বহু রাজ্যেই কংগ্রেসকে তার অবশিষ্ট জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে

এখন সবাই সমান রাজা

এ বার প্রশ্ন হল, এই যেমন শোনা যাচ্ছে দেশের নানা ক্ষত্রপদের নিয়ে তৈরি ‘ফেডারাল ফ্রন্ট’ নাকি একমাত্র মহাক্ষত্রপ রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বেই তৈরি হতে পারে, কথাটা কি সত্যি?

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

শুনেছি, পুরাকালে শক সাম্রাজ্য সামলানোর জন্য দরকার হয়েছিল ক্ষত্রপ নামে এক শাসক গোষ্ঠীর। দূর দূর প্রদেশে ক্ষত্রপরা ক্ষমতায় বহাল থাকতেন, নিজের নিজের অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতেন, দরকার মতো সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে থাকা ‘মহাক্ষত্রপ’কে সাম্রাজ্যের খুঁটিনাটি বিষয়ে ওয়াকিবহাল রাখতেন।— শব্দটা আজকাল আবার মহাসমারোহে ফিরে এসেছে, ইংরেজি অপভ্রংশ ‘সত্‌রপ’ (satrap) হিসাবে। এখন আমরা এই শব্দটা দিয়ে বুঝি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মহাপ্রতাপশালী আঞ্চলিক শাসকদের। এই ভারতে আজকাল তাঁরা কেবল নিজেদের অঞ্চলে বিরাট ক্ষমতার অধিকারীই নন, সেই ক্ষমতার উপর নির্ভর করে দেশের রাজনীতির দড়ি টানাটানির খেলাতেও তাঁরা বড় সাফল্যের আশা রাখেন।

এ বার প্রশ্ন হল, এই যেমন শোনা যাচ্ছে দেশের নানা ক্ষত্রপদের নিয়ে তৈরি ‘ফেডারাল ফ্রন্ট’ নাকি একমাত্র মহাক্ষত্রপ রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বেই তৈরি হতে পারে, কথাটা কি সত্যি? সত্যিই কি রাহুল গাঁধীর পক্ষে এই ভূমিকা পালন করে কংগ্রেসকে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে নতুন করে শীর্ষে তোলা সম্ভব? কয়েক দিন আগেই পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী দাপটের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে এই বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, রাহুল গাঁধীই দেশের একমাত্র নেতা যিনি এত রকম জায়গার এত জন নেতাকে এক জায়গায় এনে বিজেপি-বিরোধী ফ্রন্ট সফল ভাবে চালানোর ক্ষমতা রাখেন। এই যে বিরাট প্রত্যয়— শুনতে ভালই, কিন্তু কতখানি বস্তু আছে এর মধ্যে, আর কতখানি স্বপ্ন তথা দিবাস্বপ্ন?

অধীর চৌধুরীরা, কে জানে হয়তো রাহুল গাঁধীরাও, একটু বেশিই আশা করছেন। এটা ঠিক যে, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হলে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরি করা কোনও কাজের কথা নয়, তার থেকে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় ফ্রন্টই বুদ্ধির লক্ষণ। এ দেশে তৃতীয় ফ্রন্ট ব্যাপারটা কোনও কালে তেমন সফল হয়নি, বাইরে থেকে প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ফ্রন্টের (অর্থাৎ কংগ্রেস কিংবা বিজেপি) সাহায্য ছাড়া সরকার তৈরি করতে পারেনি। বিরোধী পরিসরের অঙ্কটা মনে রাখলে সহজেই বোঝা যায় যে বিজেপির বিরুদ্ধ ভোটটা কংগ্রেস ও তৃতীয় ফ্রন্টের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেলে এ বারেও সেই ফ্রন্টের সাফল্যের সম্ভাবনা হত ক্ষীণ। তাই গত মাসে যখন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও বিজেপি-বিরোধী ও কংগ্রেস-বিরোধী তৃতীয় ফ্রন্টের প্রস্তাবটা পেড়েছিলেন, অনেকেই সন্দেহ করছিলেন, এর পিছনে নিশ্চয় সাক্ষাৎ বিজেপির কালো হাত— তারাই নিশ্চয় চক্রান্ত করে বিজেপি-বিরোধীদের ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটছে। কেবল চন্দ্রশেখর রাও নন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও প্রথমে এই ‘লাইন’টাই শোনা গিয়েছিল। রাহুল গাঁধীর সঙ্গে হাত মেলানোয় বিস্তর অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে শেষ পর্যন্ত সাত-পাঁচ ভেবেচিন্তে কংগ্রেসের সঙ্গে একত্রে ফেডারাল ফ্রন্টের প্রস্তাব নিয়ে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে মমতা বৈঠকে বসলেন, তার পিছনে এই হিসাবই তো ছিল যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কাজটা হবে না। ইতিমধ্যে শরদ পওয়ারও পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে যে রকম সব বিরোধী দল মিলে জনতা দলের ছাতার তলায় যুদ্ধে নেমেছিল, তাঁদের এ বারের পরিকল্পনাটা তার কাছাকাছি। দেশজোড়া সব বিজেপি-বিরুদ্ধ শক্তি (মমতার তৃণমূল কংগ্রেস, চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি, চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি, কেজরীবালের আম আদমি পার্টি, শরদ পওয়ারের এনসিপি, এবং অবশ্যই, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টি, লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল) কংগ্রেসের সঙ্গে সকলকেই ২০১৯-এর লড়াইয়ে জুড়তে হবে, তবেই সাফল্য আসবে। অর্থাৎ কংগ্রেস সঙ্গে থাকলে তাঁদের লড়াইটা হবে সহজ।

কিন্তু কংগ্রেস? তারও তো নিজের স্বার্থ আর লড়াই আছে? তার কতটা সুবিধে হবে এতে?

সেটা কিন্তু একেবারেই পরিষ্কার নয়। কংগ্রেসের ভিতরে আজকাল অনেকেই আশায় বুক বাঁধছেন যে, ২০১৯ সালে তাঁদের নাকি একটা ‘কামব্যাক’ বা প্রত্যাবর্তন হতে চলেছে। বাস্তবিক, ২০১৯ সালে যদি বিজেপি আবার জেতে, তবে বেশ একটা ঐতিহাসিক ঘটনাই হবে। স্বাধীনতার পর সাত দশকে এক বারই কংগ্রেস ছাড়া কোনও দল পুরো পাঁচ বছর শাসন করতে পেরেছে। এবং তার পরও সেই দল পরের নির্বাচনে জিততে পারেনি— অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সেই সরকার ২০০৪ সালে শেষ হলে প্রবল প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল চিরপুরাতন কংগ্রেসেরই। তাই এ বার যদি নরেন্দ্র মোদীর সরকার পর পর দু’বার নির্বাচনে জেতে, একটা রেকর্ড তৈরি হবে। সেটাই কি হতে চলেছে? না কি ‘চিরপুরাতন’ আবারও কোমর বাঁধছে ফিরে আসার জন্য? ক্ষত্রপদের সাহায্যেই কি সে ফিরবে?

সাম্প্রতিক উত্তরপ্রদেশ উপনির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড ডিভাইডেড উই ফল’-এর মাহাত্ম্য। জোট একটা বাঁধতে পারলে আগামী ভোটে ক্ষত্রপদের সাফল্যের আশা রীতিমতো উজ্জ্বল। কিন্তু সেই সাফল্য সবটুকুই তাঁদের নিজেদের অঞ্চলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর কে চন্দ্রশেখর রাও যতই বৈঠক করুন, তেলঙ্গানায় তিনি কিংবা পশ্চিমবঙ্গে রাও দাঁতটিও ফোটাতে পারবেন না। এটাই এখন এ দেশের বড় রাজনীতিটার বৈশিষ্ট্য। আঞ্চলিক দলগুলোর এই যে সম্পূর্ণ পরস্পরবিচ্ছিন্ন প্রভাব-বলয়, এখানেই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি, আবার জাতীয় স্তরে এখানেই তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। অর্থাৎ, কংগ্রেসকে কেবল অঙ্কের জন্যই দরকার, ভাবলে ভুল হবে। কংগ্রেসকে তাদের প্রয়োজন একটা জাতীয় গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার জন্যও। কিন্তু সেই প্রয়োজনের সঙ্গে কংগ্রেসের প্রয়োজনটা মিলছে কি না, সেটাও তো বোঝা দরকার।

দেশ জুড়ে কংগ্রেসের অবস্থা এক এক জায়গায় এক এক রকম। একটা ছক তৈরি করলে দেখব, কিছু রাজ্যে (রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত) এখনও কংগ্রেসই প্রধান বিজেপি-বিরোধী শক্তি, ফ্রন্ট তৈরির মাধ্যমে আসন বোঝাপড়া হলে সে সব জায়গায় কংগ্রেস আরও ভাল করবে। দুই, কিছু রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, পঞ্জাব) কংগ্রেস হল ত্রিপাক্ষিক বা চতুঃপাক্ষিক লড়াইয়ের এক পক্ষ। সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে অন্যদের সঙ্গে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বোঝাপড়ার অর্থ— নিজের জায়গাটা অনেকটা ছেড়ে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গে যেমন, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী বোঝাপড়া হলে এ রাজ্যে কংগ্রেসের যেটুকু যা অবশিষ্ট, সেটাও ধুয়েমুছে সাফ— মাঝখান থেকে লাভ বিজেপিরই। তিন, কিছু রাজ্যে (উত্তরপ্রদেশ, ওডিশা) আঞ্চলিক দলই প্রধান বিজেপি-বিরোধী শক্তি, কংগ্রেস কেবল টিমটিম করে টিকে আছে। ফ্রন্ট-বোঝাপড়ার ফলে সেখানে কংগ্রেসের অবশ্যই বিন্দুমাত্র লাভ নেই। তৃতীয়ের মতো একই দশা চতুর্থ দলেও, যে যে রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলিই (তামিলনাড়ু, অন্ধ্র) পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে, সেখানেও কংগ্রেসের লাভের খাতায় শূন্য। আর পঞ্চম দল, যেখানে কংগ্রেস যে অবিজেপি সরকারের প্রধান বিরোধী শক্তি (তেলঙ্গানা এবং কেরল)— সেখানে ভয় অনেক বেশি, ফ্রন্টের অবকাশে বিজেপির হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ার সুযোগ বিপুল।

যোগফল? বহু রাজ্যেই কংগ্রেসকে নিজের অবশিষ্ট জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে— ১) হয় আঞ্চলিক শক্তিকে, ২) নয় বিজেপিকে। অর্থাৎ যে দিক থেকেই দেখা যাক না কেন, কংগ্রেসের এই জোটে কেবল ‘দেওয়া’র আছে, ‘পাওয়া’র তত কিছু নেই। কিন্তু নেতৃত্ব দিতে হলে তো কিছু বেশি ‘পাওয়া’ও চাই? অন্তত তেমনই তো জানা আছে? তা হলে কি রাজস্থান ইত্যাদি যে রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের নিজের অবস্থা ভাল (অর্থাৎ প্রথম দল), সেখানে কংগ্রেসের ফল অনেকটা বেশি ভাল হলে তবেই কংগ্রেসের ফ্রন্টের নেতৃত্ব দাবি করার যোগ্যতা জন্মাবে? সত্যি বলতে কী, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষতি মেরামতি করার মতো তত ‘বেশি’ অর্জন ওই সব রাজ্যে কংগ্রেস করতে পারবে কি না, সেটা একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন।

তবে কিনা, চেনাজানা মডেল ছাড়িয়ে আর এক রকমের মডেল ভাবা যেতেই পারে। যেখানে ক্ষত্রপরাই হবে শক্তিশালী, মহাক্ষত্রপটি কেবল ‘ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়ালস’, সমানের মধ্যে প্রথম। পেশি বা সংখ্যার জোর নয়, কেবল ঐকমত্যের জোরেই থাকবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভিত্তি। অর্থাৎ আগেকার দিনে যেমন ক্ষত্রপরা কেন্দ্রের হয়ে প্রান্তে প্রতিনিধিত্ব করতেন, এখনকার ক্ষত্রপরা প্রান্তে থেকেই ‘রাজ’ করবেন, কেন্দ্রে তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাবেন। মনে হয়, এ দেশে ফেডারাল ফ্রন্ট বানাতে হলে আজ আর এই মডেল ছাড়া গতি নেই। এখানে কেউ অপ্রতিহত শীর্ষনেতা নন, সকলেই সমক্ষমতাময়। কংগ্রেস এবং ফেডারাল ফ্রন্টের আহ্বায়ক— সবাইকেই বোধ হয় সে ভাবেই ভাবতে হবে। নেতৃত্ব কথাটার মানেই যে এই ভারতে পাল্টে গিয়েছে। এ দেশে এখন তাঁরা সবাই সমান রাজা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE