শাস্তির লক্ষ্য ন্যায়। যিনি শাস্তি দিতেছেন, তাঁহাকেই স্থির করিতে হয়, কোন অপরাধের কী শাস্তি ন্যায়সম্মত হইবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, শাস্তি দিবার প্রমত্ততায় দণ্ডকর্তা ভুলিয়া যান কাহাকে, কতখানি শাস্তি দিতেছেন। তখন শাস্তি ন্যায়ের পরিবর্তে অন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। সম্প্রতি এমনই প্রমত্ততার একটি নজির মিলিয়াছে। বিহারের বেগুসরাই জেলার এক গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তরের দুই ছাত্রীকে স্কুলের পোশাকের দাম ও ফি মিটাইয়া দিতে না পারার অপরাধে পোশাক খুলিয়া অর্ধনগ্ন করিয়া বাড়ি পাঠানো হয়। ঘটনাটি হয়তো বিচ্ছিন্ন, কিন্তু বিরল বলা চলে না। ‘শাস্তি’ হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের অপমান করিবার ঘটনা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাবে ঘটিতেছে। স্কুলের বেতন দিতে অপারগ হওয়ায় পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার হল হইতে বাহির করিয়া দিবার দৃষ্টান্তও অতি পরিচিত। এই ধরনের শাস্তি কোন ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, বলা কঠিন।
বিহারের ঘটনাটির অবশ্য এক গভীরতর তাৎপর্য আছে। পাঁচ-ছয়-সাত বছরের শিশুরা স্কুলের বেতনের মর্ম কতখানি বোঝে? তাহাদের এই রূপ শাস্তি দিয়া কি বোঝানো গেল যে বিনা বেতনে স্কুলে পড়াশোনা করা যায় না? না কি, তাহারা বুঝিল যে অভিভাবক যদি স্কুলে বেতন দিতে অপারগ হয়, তাহা হইলে অর্ধনগ্ন অবস্থায় তাহাদের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হইবে? আশঙ্কা হয়, তাহাদের মনে ও মস্তিষ্কে এক অপরিসীম ভয়, অপমান, লজ্জা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ গাঁথিয়া গেল। হয়তো বা এই অনুভূতিগুলিই ভবিষ্যতে এই শিশু দুইটির প্রকৃতি স্থির করিবে। হয় তাহারা তীব্র অপমানের ক্ষত লইয়া ভয়ে সংকুচিত থাকিবে, অথবা ভয়ংকর ক্রোধ লালন করিয়া এমন এক ব্যক্তিত্বে উপনীত হইবে, যাহা কোনও ভাবেই কাম্য নহে। শিশুর স্বাভাবিক মনোবিকাশের পথে এমন একটি শাস্তি বড় রকমের প্রভাব ফেলিতে পারে। অথচ শিশুদের পড়াশোনা শিখাইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের ব্যক্তিত্ব গঠন এবং মানসিক বিকাশে সাহায্য করিবার কাজটি শিক্ষকদেরই করিবার কথা। সেই শিক্ষক যদি গড়িবার বদলে ভাঙিবার ব্রতে উদ্যত হন, তাহা হইলে সমাজের ভবিষ্যৎ লইয়া প্রশ্ন ওঠে।
অবশ্যই, শিক্ষকও এক জন মানুষ। তাঁহারও সাধারণ অনুভূতি প্রকাশের অধিকার রহিয়াছে নিশ্চয়। কিন্তু কিছু পেশার ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু দায়িত্ব থাকে। কেবল স্কুলে ছাত্রদের পড়াইয়া শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয় না। তাঁহাকে ছাত্রছাত্রীদের সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব গঠন করিতে হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি তাহাদের বোধ, বুদ্ধি, ঔচিত্যজ্ঞান, নীতিবোধ, সবই নির্মাণের দায়িত্ব শিক্ষকের। দায়িত্ব যত গুরু হয়, দায়িত্বপ্রাপ্তের কর্তৃত্ব করিবার ক্ষমতাও বাড়ে। সমস্যা সেখানেই। ক্ষমতার মৌতাত মানুষকে দায়িত্বজ্ঞানহীন করিয়া তুলিতে পারে। তখন সে আপন বিবেচনাবোধ ব্যবহার না করিয়া কেবল ক্ষমতা ব্যবহার করিতে চায়। ক্ষমতার নেশা কাণ্ডজ্ঞানও হরণ করে। শিক্ষক যদি কাণ্ডজ্ঞানহীন হইয়া, পরিস্থিতির গুরুত্ব না ভাবিয়া শাস্তি দেন, যাহাকে শাস্তি দিতেছেন তাহার উপর সেই শাস্তির প্রভাব কী হইতে পারে তাহা বিচার না করেন, তবে সেই শাস্তি ক্ষমতান্ধতার প্রকাশ হইয়া দাঁড়ায়। তাহাতে ন্যায়ের আভাসটুকুও থাকে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy