সনাতন: রাষ্ট্রীয় প্রচার, মিডিয়ায় উঠে আসা চেহারার বাইরে যে ভারত। হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা, দিল্লি
জননীর পরলোকগমনের পর সাত-আট বছর বয়স অবধি গ্রহণী, অর্শ ইত্যাদি যন্ত্রণাদায়ক রোগে শয্যাগত হয়ে থাকতাম। ঠাকুরমা দিবানিশি আমার শয্যাপার্শ্বে জেগে বসে থাকতেন। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কত কাল এই ভাবে অতিবাহিত হয়েছে। অনিদ্রায়, অনাহারে ঠাকুরমার সে সময় কত দিবানিশি কেটে গেছে। মৃত্যু যেন আমার একটি হাত ও ঠাকুরমার একটি হাত ধরে টানছিলেন। অবশেষে ঠাকুরমা জয়ী হলেন এবং আমি নিরাময় হতে আরম্ভ করলাম। আমার পীড়ার সময় ঠাকুরমা করজোড়ে সকল দেবদেবীর কাছে আমার জীবনভিক্ষা করছিলেন। বালেশ্বরে দু’জন পীর ছিলেন। অবশেষে ঠাকুরমা সেই দুই পীরের শরণ নিলেন। তাদের কাছে তিনি মানত করলেন, ‘আমার বাছা ব্রজ ভাল হয়ে গেলে আমি তাকে তোমাদের ফকীর বা গোলাম করে দেব।’ প্রথমে আমার নাম রাখা হয়েছিল ব্রজমোহন। পীরদের মনস্তুষ্টির জন্য ঠাকুরমা আমার এই মুসলমানী নাম রেখেছিলেন। কিন্তু ঠাকুরমা সর্বস্ব ত্যাগ করে আমাকে পীরদের হাতে তুলে দিতে পারলেন না। কেবল প্রতিবছর মহরমের সময় আটদিনের জন্য আমাকে ফকীর করে দিতেন। সেই কটা দিন আমি ফকীরের পোষাক পরে থাকতাম, হাঁটু অবধি একটা জাঙ্গিয়া দেহে হরেক রঙের কাপড়ের আচকান, মাথায় ফকীরি টুপি, কাঁধে নানা রঙের একটি ঝোলা এবং হাতে গলায় প্রলেপ দেওয়া লাল রঙের একটি লাঠি। সেই পোষাক পরে মুখময় খড়ির গুঁড়ো মেখে সকালে বিকেলে গ্রামের মধ্যে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করে ফিরি, সন্ধ্যার সময় সেই ভিক্ষালব্ধ সমস্ত চাল বিক্রী করে যা পয়সা পেতাম পীরদের সিন্নির জন্য সে সমস্ত পাঠিয়ে দেওয়া হত।” (আত্মচরিত:ফকিরমোহন সেনাপতি; অনুবাদ মৈত্রী শুক্ল। সাহিত্য আকাদেমি। বানান অপরিবর্তিত)
ওডিশার লেখক ফকিরমোহন সেনাপতির জন্ম (১৮৪৩) বালেশ্বরে। তখন ভারতবর্ষ ঠিক কেমন ছিল, আজ বোঝা দুষ্কর। কিন্তু এই চিত্রটি আমার মতো, আরও অনেক ভারতবাসীকেই ধাক্কা দেবে।
স্বাধীন ভারতে জন্মের পর থেকে জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে আসছি, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের মানুষ। জ্ঞাতি পড়শি পাকিস্তানের চেয়ে এক ধাপ সভ্যতার সপক্ষে এগিয়ে। বাল্যে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বিষয়টি রেডিয়োর সংবাদপাঠ ছাড়া আর কোথাও ছিল না। কারণ জীবনযাপনের ত্রিসীমানায় ‘হিন্দু’ ছাড়া কিছু ছিল বলে মনে পড়ে না। স্কুল কলেজের গণ্ডিতে কোনও শিক্ষক বা সহপাঠী ছিল না। এমনকী, দারোয়ানও না। পার্কসার্কাসে এক আত্মীয়ের বাড়ি ছুটিছাটায় থাকতে গেলে, সেখানে সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করেছি। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ মুসলমান ছিল না। মুসলমান বলতে ইদের ছুটি আর কালেভদ্রে বিরিয়ানি। আর বড়দের আলোচনা থেকে মনে হওয়া যে দেশভাগের জন্য দায়ী কোনও অনির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠী। ওপার বাংলার মামাবাড়িতে আমার উকিল মাতামহের কাছারি ঘরে হিন্দু মক্কেলদের জন্য চেয়ার আর মুসলমান মক্কেলদের জন্য বেঞ্চি পাতা ছিল। সেটাই ছিল সামাজিক দস্তুর। জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজোয় মণ্ডপের সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শূদ্র আর মুসলমান প্রজাদের বাড়ানো হাতে সীমানার ভিতর থেকে জমিদারগিন্নি প্রসাদ তুলে দিতেন ছোঁয়া বাঁচিয়ে। অথচ মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত মণ্ডপসজ্জা, ঠাকুর গড়া, সব কিছুতেই তাঁদের দুটি সক্রিয় হাত না থাকলে কাজ সম্পূর্ণ হয় না।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চেহারাটাও অনেকটা এই রকম। ভাতা, অনুদান আর প্রতিশ্রুতি ছুড়ে দেওয়া সীমানার ওপারে। একাসনে বসবার অধিকারটুকু শুধু দেওয়া যাবে না সামাজিক ভাবে। এখন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অধিকারও যাতে না দেওয়া হয়, তার প্রস্তুতি।
১৯৯২ থেকে বুঝতে শুরু করেছি সংখ্যাগুরু শব্দের মহিমা। চোখের সামনে টিভিতে দেখেছি চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ল বাবরি মসজিদ। তার পর ২০০২-এ গুজরাতের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে বুঝেছি সংখ্যাগুরু-র ওজন। আর এখন আখলাক থেকে পদ্মাবতী— প্রতি দিন হয় মুসলমান, নয় দলিত, অথবা আদিবাসী হত্যার খবর আসে, সংখ্যাগুরু শব্দের মহিমা, ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য রাষ্ট্রই বুঝিয়ে দেয় তার নিজস্ব ভাষায়। যা হওয়ার কথা ছিল জনগণের, দুর্বলের রক্ষাকবচ; তা হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের বর্ম। গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা এই দুটি শব্দই এখন স্বেচ্ছাচারিতার সবচেয়ে বড় রক্ষক।
সংখ্যানির্ভর গণতন্ত্রের নিয়মে জনসাধারণের ভোটে জয়ী হয়ে এসে সংবিধানের শপথ ভেঙে কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তি যদি বিভাজনের রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে (যার বীজ লুকিয়ে আছে সংখ্যানির্ভরতার ভিতর) রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মীয় তকমা লাগাতে উদ্যোগী হয়, আমরা, বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষ, চুপ হয়ে যাই। এই চুপ হয়ে যাওয়াই রাষ্ট্রের পক্ষে সম্মতি হয়ে দাঁড়ায়। সম্মতি যে রাষ্ট্র পেয়ে যাচ্ছে, এটা বোঝার চেতনাও জাগ্রত হয় না। কারণ চেতনা জাগানোর কাজটি যাঁদের দায়িত্ব সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এক সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাস করেন। এত কাল গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার ভ্রান্ত পাঠ আমাদের এই বিচ্ছিন্নতাই শিখিয়েছে।
অথচ এই রাষ্ট্রীয় প্রচার, মিডিয়ায় উঠে আসা চেহারার বাইরেও আছে আর এক ভারত। ফকিরমোহনের বাল্যের ভারত। কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিশ্বাসের ভিত আজও সেখানে এতটাই মজবুত যে রাষ্ট্রের বিভাজনের নিরলস প্রচেষ্টা তেমন কল্কে পায় না।
১৯৩১ সালের জনগণনার রিপোর্টে ‘কাস্টম অ্যামংস্ট দ্য হিন্দুজ অব বম্বে অব ইনিশিয়েটিং দেয়ার চিলড্রেন অ্যাজ ফকিরস’ শিরোনামে উল্লেখ পাই ওই একই রীতির। বাৎসরিক মহরম অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী হিন্দুরা (বিভিন্ন জাতের, বিশেষত চাষ ও কারিগরির সঙ্গে যুক্ত।) প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যোগদান করত। অনেক সময় সন্তান কামনায় মহরমের তাজিয়ার গম্বুজও হিন্দু বাড়িতে রেখে দেওয়া হত। বাড়ির বাচ্চাদের স্নান করিয়ে উপযুক্ত পোশাক পরিয়ে ফকির হতে পাঠানো হত। সারা দিন ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে দিনের শেষে ভিক্ষালব্ধ খাবার খেতে হত। মহরমের শেষে বেঁচে যাওয়া খাবার সাধারণের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। যে হিন্দুরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম অংশ নিতেন, নবির মাহাত্ম্যে তাঁদের স্থির বিশ্বাস ছিল। সামাজিক কোনও বাধা ছিল না। বিশ্বাসে ভেজাল না মিশলে এমনটি হওয়াই সঙ্গত।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার পর রাজনৈতিক নানা সংঘাতে আমরা বার বার রাষ্ট্রকে দেখেছি ধর্মের অপব্যবহার করতে। মানুষের সবচেয়ে দুর্বল আর মানবিকবোধের জায়গায় আঘাত করতে। তারই ফল আজকের ভারতে সংখ্যাগুরুর আস্ফালন। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহৃত হতে দেখতে দেখতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয় এই বুঝি শেষ সত্য।
কিন্তু এর অন্তরালে আছে সেই বিশ্বাসের সংযুক্তির ভারতবর্ষ। তাকে অস্বীকার করা যাবে না।
এখনও দিল্লিতে ‘হুসেনি ব্রাহ্মণ’দের মহরমের শোভাযাত্রা বের হয় প্রতি বছর। এঁদের উৎপত্তি নিয়ে নানা রকম কাহিনি (কিছু ইতিহাস কিছু লোককথা) প্রচলিত। এখনও রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাবে বেশ কিছু হুসেনি ব্রাহ্মণ আছেন। আছেন পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে ও পঞ্জাবেও। আছেন আরবেও। শিশিরকুমার মিত্রের দ্য ভিশন অব ইন্ডিয়া’তে উল্লেখ আছে যে কারবালার ঘটনার আগে বড় সংখ্যক হিন্দু বাস করতেন আরবে। অনেকেরই মতে, হুসেনি ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাহাব সিধ দত্ত। কারবালার ঘটনার সময় বাগদাদে ১৪০০টি ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন। এই যুদ্ধে তাঁরাও হুসেনের পক্ষে যোগ দেন বলে কথিত আছে। অনুমান করা হয়, এই পরিবারগুলিই হুসেনি ব্রাহ্মণের আদি। ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে এঁরা ভারতে এসে শিয়ালকোটের দিনানগর আর রাজস্থানের পুষ্করে থিতু হন। বেশ কিছু সৈয়দও সঙ্গে আসেন।
এঁদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইমাম হুসেন ও তাঁর বংশ ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। খুব গর্বের সঙ্গে এঁরা স্মরণ করেন সেই জড়িয়ে থাকাকে। অনেকে গলায় একটি কাটা দাগ তৈরি করেন কারবালা যুদ্ধে তাঁদের পূর্বপুরুষের আত্মদানের স্মৃতিতে। আমাদের অতি পরিচিত চিত্রতারকা সুনীল দত্তের পরিবার এই সম্প্রদায়ের মানুষ। সেনাবাহিনীর বেশ বড় একটা অংশেও এই সম্প্রদায়ের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। পঞ্জাব গুজরাত বা মহারাষ্ট্রের চারণ গানে হিন্দুদের কারবালার যুদ্ধে আত্মদানের কথা এখনও শোনা যায়। শোনা যায় সিন্ধুপ্রদেশের লোকগানে।
এ ভাবেই সাধারণের জীবনে ইমাম হুসেন আর শ্রীকৃষ্ণ মিলেমিশে থাকেন। দেওয়াল তুলতে হয় না। ভিটে আলাদা করার কথা ওঠে না।
এই বিশ্বাসের ভিতও টলাতে চায় বিভাজনের রাজনীতি। কিন্তু সংস্কৃতি সঙ্গ দেয় না। তাই কাজটা কঠিন। খুব চেনা আমাদের এই বিশ্বাস। লালন আর সুফি গানে, মারফতির টানে আমরা তো কবে থেকেই জানি জল আর পানি একই জিনিসের দুটি নাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy