বাবা হইয়া ছেলেকে দুর্নাম হইতে বাঁচাইতে মরিয়া চেষ্টা করার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই। বিশেষত যদি সেই বাবা হন দেশের দ্বিতীয় প্রধান ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতা! অমিত শাহের পুত্রকীর্তি-সমর্থন বিরক্তিকর হইলেও অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। অভিযোগ এখনও মুখের কথাতেই আটকাইয়া, তদন্তের ‘ত’ পর্যন্ত শুরু হয় নাই, কিন্তু সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতির পুত্র জয় অমিত শাহ যে ‘অবশ্যই’ নির্দোষ, তাঁহার ব্যবসায়িক কোম্পানির কাগজপত্রে যে কোনও অনিয়মের হদিশ পাওয়া ‘অসম্ভব’, এ সব কথা পিতৃমুখে প্রবল গর্জনে ধ্বনিত হইতেছে। সঙ্গে সঙ্গে যে বা যাহারা অভিযোগ আনিয়াছে, ‘অবশ্যই’ সেই পত্রিকার বিরুদ্ধেও এক শত কোটির মানহানির মামলা দায়ের হইয়াছে। অস্বাভাবিক নহে। অভিযোগ উত্থাপনকারীরাও সম্ভবত জানিতেন, যাঁহার পু্ত্রকে তাঁহারা নিশানা করিতেছেন, তিনি বড় দরের মামলা অবধি ঠেলিয়া দিবেন। এ সব কিছুই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশাপরিধির অন্তর্গত। তবে কিনা, যাহা এই পরিধির বাহিরে চলিয়া গিয়া দেশবাসীকে বিস্মিত করিয়াছে, তাহা হইল জয় অমিত শাহের খবর আসিবামাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সরকারি মহলের প্রতিক্রিয়া। জয় অমিত শাহ তাঁহাদের বাড়ির লোক নহেন, তবু তাঁহারা চিতার ক্ষিপ্রতায় লাফাইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাকে নির্দোষ বলিয়া ঘোষণা করিতে সমস্ত রকম প্রোটোকল কিংবা নৈতিকতার মাত্রা অনায়াসে ছাড়াইয়াছেন। তদন্ত তো দূরস্থান, এখনও পর্যন্ত কোনও একটি তথ্যপ্রমাণের বিন্দুও সামনে আসে নাই, অথচ স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলিয়া দিয়াছেন যে জয় অমিত শাহ নিষ্কলঙ্ক। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়াল জানিয়া গিয়াছেন যে এই অভিযোগ ‘অর্থহীন, অপমানজনক, অসম্মানপূর্ণ’। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হইয়া সরকারি দলের ঘরের মানুষকে এমন দিগ্বিদিকচেতনাহীন সমর্থন যে সরকারের পক্ষে প্রবল অসম্মানজনক, তাহা তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন না?
কিংবা হয়তো তাঁহারা ষোলো আনা বুঝিতে পারিলেন, তবু গা করিলেন না। কেনই বা করিবেন? করিবার কোনও দায় তাঁহাদের নাই, কোনও চাপও নাই। প্রধানমন্ত্রী, আরও এক বার, প্রকাশ্যে মুখ খুলিলেন না। অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেলকে দ্রুত জয় অমিত শাহের পক্ষ সমর্থন করিবার সম্মতি দেওয়া হইল। কোনও ‘সাধারণ’ নাগরিককে সরকারি সলিসিটর জেনারেল কেন, কোন অধিকারে সরকারি নির্দেশে সুরক্ষা দিবেন, এ প্রশ্ন অনাবশ্যক, বালখিল্যোচিত। ইহার পিছনে কেবল দল-পোষণ ও ব্যক্তিতোষণ নাই, সরকারি ব্যবস্থার এক বিরাট অপব্যবহার আছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই অপব্যবহারে কত অনায়াস সম্মতি দিতে পারে, তাহাই প্রমাণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি এই সরকারের অবজ্ঞা কত দূর স্পর্ধিত!
জয় অমিত শাহের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি কত দূর সত্য, তথ্যসাবুদ কী বলিবে, এই সব এখনও অজানা ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু আসল সংকট সেই অভিযোগের সত্যতার মধ্যে নয়। আসল সংকট, অভিযোগ আড়াল করিবার জন্য সরকারি ক্ষমতার এই নির্লজ্জ ও দুর্দান্ত অপব্যবহারের মধ্যে, রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার প্রতি সরকারের এই হিমালয়প্রমাণ অবজ্ঞা এবং স্পর্ধার মধ্যে। বিজেপির অন্দরেই নেতারা অপ্রসন্নতা প্রকাশ করিতেছেন। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা প্রকাশ্যেই বলিয়াছেন, এই একটি ঘটনাতেই বিজেপি তাহার নৈতিক জোর হারাইল! প্রধানমন্ত্রীর নাম তিনি করেন নাই। তবে যেটুকু বলিয়াছেন, তাহাই প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ললিত স্লোগান ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’র কথা মনে করাইবার পক্ষে যথেষ্ট। মোদী ও শাহ একটি মহাপরীক্ষার সামনে পড়িয়া দেখাইয়া দিলেন, কত সাবলীল ভাবে তাঁহারা সততার পরীক্ষায় ফেল করিতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy