হাতি-ও-ড্রাগন: ইস্ট লেক-এর উপর হাউসবোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। উহান, চিন, ২৮ এপ্রিল। ছবি: এএফপি
দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর চিঠিচাপাটি চলত। ১৯৬২ সালে চিনের সঙ্গে সংঘর্ষের পর রাসেল নেহরুর কাছে জানতে চান, এ বার কী ভাবছেন? ’৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যু হয়। তার আগে ’৬৩ সালে তিনি জবাবে রাসেলকে বলেছিলেন, যা হয়েছে, তা তো হয়েই গিয়েছে। কিন্তু এত তাণ্ডবের পরেও বলব, দু’দেশের সম্পর্কের সংঘাত যদি ঘোচাতেই হয়, তবে কিন্তু আলোচনায় বসাই একমাত্র কাজ। নেহরু মৃত্যুর আগে সংসদেও এ কথা বলেছিলেন।
তিরিশ বছর আগে দিল্লি এসেছি। সেই তখন থেকেই দেখছি, বিজেপির শীর্ষ নেতারা বার বার বলেন, ’৬২ সালের যুদ্ধের জন্য নেহরুই দায়ী। কিছু কূটনীতিকও নেহরুকে দোষারোপ করেন। আমি ইতিহাসবিদ নই, কূটনীতিক নই, পণ্ডিতও নই, তবে দিল্লির রাজনীতির জিজ্ঞাসু পর্যবেক্ষক হিসাবে মনে হয়েছে, নেহরুই দায়ী— এমনতর চরম নির্দেশবাদী মন্তব্য যেমন অবৈজ্ঞানিক, তেমনই নেহরুর কোনও ভুল হয়নি— এ হেন অতিভক্তিও ভাল নয়। আসলে আমার মনে হয়, দু’জন নেহরু ছিলেন। এক নেহরু দার্শনিক প্রধানমন্ত্রী। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান ভোলানাথ মল্লিক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, চিনের হুমকি শুনেও নেহরু বিশ্বাস করতে চাইতেন না, এ হেন সুদীর্ঘ হিমপথ অতিক্রম করে, এ রকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চিন ভারতকে আক্রমণ করবে। নেহরু বলতেন, পঞ্চশীলের উদারপথ ধরে মন জয় করাই তো চিনের পক্ষে উচিত কাজ। অন্য নেহরু প্রশাসক প্রধানমন্ত্রী, যিনি পশ্চিমের আকসাই চিন আর পূর্ব দিকের তথাকথিত ম্যাকমোহন লাইন— এই দুই সীমান্ত নিয়ে চিনের তোলা বিতর্ককে মানতে রাজি হননি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন যে সীমান্ত তৈরি করে দিয়েছে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন ও দেশ ভাগের পর উত্তরাধিকার সূত্রে, তার অধিকার ভারতেরই। আর এই বিবাদ থেকেই জন্ম নেহরুর ফরওয়ার্ড পলিসি-র।
আজ এত বছর পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রথমে সাবরমতী নদীর তীরে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংকে ডেকে এনে ঝুলায় বসিয়ে প্রেমের ফাঁদ পেতেছিলেন, আর তার পরেই ভুটানের ভূখণ্ড ডোকলাম-এ চিনা সেনার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। প্রথমে সেই আধিপত্যের প্রতিবাদে পাল্টা আধিপত্য প্রদর্শনের বাহুবলী যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। কিছু দিনের মধ্যেই বোধোদয়— চিনের সঙ্গে এ হেন ছেলেমানুষি টক্কর ঠিক হচ্ছে না। মার্কিন কূটনৈতিক চাপও বাড়তে লাগল। কারণ, বিশ্ব পরিস্থিতিও জটিলতর। অতএব, এ বার মেরামতির কূটনীতি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ছুটলেন শি-র কাছে।
তবু বলব ভাল। রাসেলকে নেহরু যেমনটি বলেছিলেন, পরিশীলিত কূটনীতিতে আলাপ-আলোচনাই উচিত কাজ। দেরিতে হলেও লোকসভা ভোটের এক বছর আগে মোদী যে গেলেন, বরফ গলানোর চেষ্টা করলেন, তাকে সাধুবাদ জানাই।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটটা দেখুন। আমেরিকা ও রাশিয়ার বিবাদ ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের চেয়েও বেশি খারাপ। ইউক্রেন, সিরিয়া আর আফগানিস্তানে ছায়াযুদ্ধ চলছে। সিরিয়ার ওপর মার্কিন-ফরাসি-ব্রিটিশ সমবেত ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ দেখে পৃথিবী এখন ত্রস্ত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে পশ্চিমের নামী পত্রপত্রিকায় প্রচ্ছদ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে। আমেরিকার সংসদে বহু সদস্য প্রেসিডেন্টের হাতে পরমাণু বোমা ফাটানোর বোতাম টেপার একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করার দাবিতে সরব। তার পর দেখছি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প বৈঠকে বসতে রাজি। উত্তর কোরিয়ার কিম দক্ষিণ কোরিয়াতে পৌঁছে যে দিন ঝগড়া মেটানোর এক অভূতপূর্ব বার্তা দিলেন, সে দিনই মোদীর শীর্ষ বৈঠক হল শি-র সঙ্গে।
একটা মোদী-শি বৈঠকে সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান হবে না। চিনের মনস্তত্ত্ব না বুঝেই খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রথমে চিন সমস্যা শুধুই ঘরোয়া অপটিক্স-এর মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে আরও বিপদে ফেলে দিয়েছেন ভারতীয় বিদেশ নীতিকে। প্রথমত, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সফল প্রশাসক হলেও মোদী কোনও দিনই বিদেশ নীতি নিয়ে কাজ করেননি। ভাইব্রান্ট গুজরাত-এ বিদেশি লগ্নিকারীদের ডেকে আনাই কূটনীতির সাফল্য নয়। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ দিনের ভারত-চিন মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই ব্যক্তি মোদীর ঘরোয়া ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়া ভুল কৌশল। প্রথমে আমলা, তার পর বিদেশমন্ত্রী— ধাপে ধাপে এগোনো উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সমাধানে নেমেছেন, ফলে তুরুপের শেষ তাসটি আমরা ব্যবহার করে বসে আছি। এখন ডোকলামের মতো আবারও কোনও সমস্যা হলে সমাধানে প্রধানমন্ত্রীকেই আসরে নামতে হবে।
হেনরি কিসিংগার তাঁর চিন সংক্রান্ত বইটিতে বার বার বলেছেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন তাঁকে পাঠান, তিনি চিনের মানসিকতার শিকড়টি প্রথমে গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। আমেরিকার সার্বভৌম স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব থাকলেও চিনের মনস্তত্ত্ব বুঝতে তিনি বেশি জোর দেন।
চিনের চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের ‘সিঙ্গুলারিটি’ বা একমুখিতা আছে। চিন খুব আত্মবিশ্বাসী, তারা আগ বাড়িয়ে কোথাও যেতে চায় না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব স্থাপনে তৎপর হয় না। মাও তাঁর দীর্ঘ শাসন কালে এক বার মাত্র বিদেশে যান, এবং সেটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। হেনরি কিসিংগার বলেছেন, অন্য সব দেশ হয় তার ভৌগোলিক ল্যান্ডমার্ক অথবা জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে নিজের দেশের নামকরণ করে। চিন তা করেনি। চিনা ভাষায় তাদের দেশের নাম Zhong Guo— যার অর্থ ‘মিডল কিংডম’ অথবা কেন্দ্রীয় দেশ। নিজেদের সম্পর্কে এই চিনা মনোভাবটা কিসিংগার বুঝতে বলেন।
চিন অনেক বদলেছে, একমুখিতা থেকে বেরিয়ে বিশ্বে নিজের শক্তিকে নয়া ঔপনিবেশিক স্টাইলে প্রসারিত করতে চাইছে। কিন্তু সুন ৎসু, তাঁর বিখ্যাত দি আর্ট অব ওয়র গ্রন্থে বলেন, সব সময় সামরিক অর্থে যুদ্ধের প্রয়োজন হয় না। হুমকি ও সতর্কবার্তার মাধ্যমে অন্য দেশকে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ভয় দেখিয়েও কখনও কখনও জয় লাভ সম্ভব। সার্বভৌম ভূখণ্ডের বাইরে ‘ওবর’ নামক উন্নয়নের অস্ত্রে, যে সমুদ্র অভিযানে একদা চিন ছিল নিরুৎসাহ, সে ক্ষেত্রেও সক্রিয় সমুদ্রমন্থন শুরু করে চিন এক নতুন যুদ্ধের কৌশল নিচ্ছে।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেছেন, চিরস্থায়ী শান্তি দু’ভাবে আসতে পারে। একটা রাস্তা হল মানবিকতার, অন্যটি হল সংঘাত-হিংসার, যার পর শান্তি ছাড়া অন্য কোনও পথ থাকে না। কিসিংগার ২০১১ সালে এসে কান্টের উক্তি স্মরণ করে বলেছেন, ‘‘চিন আজও সেই পথেই হাঁটছে না তো!” ১৯৬২ সালে ভারতকে আক্রমণ করার আগে মাও নাকি তাঁর দলীয় শীর্ষ নেতাদের চিন দেশের প্রাচীন যুদ্ধের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছিলেন, চিরস্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য মাঝে মাঝে যুদ্ধ হওয়া ভাল। ২০১৮ সালে এসে শি সে ভাবেই ভাবছেন না তো?
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, আর্থিক পরিস্থিতির তুলনায় হাতি এখনও ড্রাগনের থেকে অনেক পিছিয়ে। মোদীর চিনে গিয়ে সংঘাত প্রশমনের কূটনীতিকে তাই স্বাগত জানাই। কিন্তু চিনা ডিএনএ বোঝার জন্য আরও মেধার উৎকর্ষ আশা করি মোদী সরকারের বিদেশ নীতিতে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy