Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

যদি একা পেয়ে কেউ কিছু...

দিদি আর বোন, দু’জনেই যে কাগজে পড়েছে সেই খবর। ছত্তীসগঢ়ের একটি বিয়েবাড়িতে সতেরো বছরের এক কিশোরীকে তারই এক আত্মীয় এবং তার গাড়িচালক ধর্ষণ করেছে।

মৌ ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৮ ০০:২৫
Share: Save:

এক একটি করে শিশুকন্যা ধর্ষণের খবর আসে মিডিয়ায়, আর কোটি কোটি বালিকা-কিশোরীর মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। বাপের বাড়িতে বিয়ে, তবু মায়েরা এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে সাহস পান না মেয়েকে। হয় নিজে নজর রাখছেন, নয় আর কেউ সে ডিউটি করছে। সে দিন এক বিয়েবাড়িতে সেজেগুজে বসে থাকা কনে বৌ নিজেই সারা ক্ষণ আগলে রইলেন তাঁর দিদির মেয়েকে। একা পেয়ে কেউ যদি বোনঝিকে কিছু করে বসে? ‘‘তুই আমার পাশ থেকে কোথাও যাবি না।’’

দিদি আর বোন, দু’জনেই যে কাগজে পড়েছে সেই খবর। ছত্তীসগঢ়ের একটি বিয়েবাড়িতে সতেরো বছরের এক কিশোরীকে তারই এক আত্মীয় এবং তার গাড়িচালক ধর্ষণ করেছে। তার পর থেকে বিয়েবাড়িতে আর পাঁচ জনের সঙ্গে আনন্দ করা ঘুচে গিয়েছে। মেয়েকে চোখে চোখে রাখাই এখন একমাত্র কাজ।

এমনকী স্কুলেও স্বস্তি নেই। স্কুলবাস, পুল কার, কিছুই নিরাপদ মনে হচ্ছে না। অফিসে দেরি হচ্ছে, সংসারের কাজ পড়ে থাকছে, তবু শিশুকন্যার সঙ্গে মায়েরা ছুটছে স্কুলে। পৌঁছে দিয়েও স্বস্তি নেই। মাসিদের হাত ধরে মায়েরা অনুরোধ করছে, মেয়ে যখন বাথরুমে যাবে তুমি একটু সঙ্গে থেকো।

এই মায়েদের দলে আমিও আছি। কলকাতার একটি নামীদামি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক সাড়ে তিন বছরের এক শিশুকে নিগ্রহ করার অভিযোগ খবরে বেরোয়। তার পর থেকে মেয়েকে নানা কথা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কুলে পাঠাই। দারোয়ান কাকু বা কোনও পুরুষ শিক্ষক যদি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, তুমি চিৎকার করবে। ফাঁকা ঘরে একা ঢুকবে না। স্কুলের টয়লেটে কোনও বন্ধুকে নিয়ে যাবে, কখনওই একা যাবে না।

খবরে এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের লোকই অভিযুক্ত। যে শিশুটিকে ধর্ষণ করছে, সে-ই হয়তো শিশুটি জন্মানোর সময় তাকে কোলে তুলে আদর করেছিল। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, তাদের সকলকেও ‘বিশ্বাসযোগ্য’ লোকের দলে ফেলা চলে না। অতএব পুরুষ আত্মীয়েরা মেয়েকে কোলে নিলে‌ও একটু অস্বস্তি হচ্ছে মা-কাকিমার। লজেন্সের লোভ দেখিয়ে প্রতিবেশী নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শিশুধর্ষণ করেছে, তার উদাহরণ তো অজস্র। তাই এখন পাশের বাড়ির আঙ্কলের সঙ্গেও বেশি মেশা নিষেধ।

অথচ কেন এত সাবধানতা, সে কথা খোলাখুলি বলতে পারছি না মেয়েকে। ‘ব্যাড টাচ’, ‘গুড টাচ’ শেখাচ্ছি কেবল। আমার এক বন্ধু বলল, ‘‘আমার মেয়ে আসিফা সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে। কী বলব, বুঝতে পারছি না।’’ ছোট্ট মেয়েটির প্রশ্ন, আসিফার কী হয়েছিল? কেন ‘জাস্টিস ফর আসিফা’ লেখা হচ্ছে? আমার চেনা কোনও মা-ই তা খুলে বলতে পারেননি শিশুকন্যাকে। কোনও এক অজানা বিপদের ভয় যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছি তার মনে।

চিন্তা হয়, শিশুকন্যাকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে ওর শৈশবকেই কি বিপন্ন করছি? সকলকে ‘সম্ভাব্য ভিলেন’ বলে দেখা কি শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক? সে দিন পরিচিত এক মহিলা বললেন, ‘‘আসিফার খবর পড়ার পর আমি মেয়েকে অনেক বার সাবধান করেছি। এখন ওর বাবা আমাকে বলছে, ‘তোমার জন্য ও আর কোনও দিন ভাল মানুষ চিনতেই পারবে না। যাকে দেখবে তাকেই সন্দেহের চোখে দেখবে’।’’

মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় আশ্বাস দিচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের সাবধান করলে তার শৈশব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহ একটি শিশুর মনেও আঘাত করে। সে সারা জীবন ওই ‘ট্রমা’ থেকে বেরোতেই পারে না। তাই যৌন হেনস্থার বিষয়ে ওদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করাই ভাল।

এই পরামর্শ নিয়ে বিতর্ক নেই। কিন্তু একটি শিশুর সঙ্গে তার চার পাশের জগতের সম্পর্ক কেমন হবে, তা-ও তো তার মা-বাবাই অনেকটা ঠিক করে দেয়। এক জন ভাল মা কী করবেন, কেমন হবেন, তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। ‘ব্যাড টাচ’ প্রভৃতির ধারণা বিদেশ থেকে এসেছে। এগুলোর তো বাংলা শব্দই নেই। অথচ বিদেশে মায়েরা সর্বক্ষণ মেয়েদের উপর নজরদারি করছেন, এমন তো নয়। বালিকা-কিশোরীরা স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা করে, অন্তত এখানকার চেয়ে বেশি স্বাধীন তো বটেই। মায়েদের অফিসের কাজ, সংসারের কাজ, বিনোদন— সবই সেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।

এ দেশে মনে করা হয়, সন্তান হওয়ার পর তার দেখাশোনার কাজটাই মায়ের ‘আসল’ কাজ। বাকি যা কিছু মা করবে— তা সে যত বড় পদেই কাজ করুক— ওটাই তার ‘নিজের’ কাজ। নিজের চাইতে মা সন্তানকে বেশি গুরুত্ব দেবে, তাই নিজের সব কাজ ফেলে শিশুকন্যাকে সব সময় পাহারা দেবে, এটাই আশা করা হয়। মায়েরাও তা ধরে নিচ্ছে। সারা ক্ষণ ‘না না না’ নিষেধের কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখছে শিশুদের। সেই সঙ্গে বাঁধা পড়ছে নিজেও। পাছে অপরাধ হয়, সেই আশঙ্কায় নিজের ওপর আগাম শাস্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mothers Girl Child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE