কলিকাতার হরিদাস মাইতি নামক এক ব্যক্তি ফুলমণি দাসীকে বিবাহ করে। ফুলমণির বয়স নাকি এগারো বৎসর। রাত্রিতে স্বামী স্ত্রী শুইয়া আছে, হঠাৎ ম’লাম ম’লাম বলিয়া ফুলমণি চিৎকার করিয়া উঠিল। তাহার যোনি হইতে রক্তস্রাব হইয়া অল্পক্ষণের মধ্যেই সে গতাসু হইল’। ১৮৯১ সালে লিখেছিল ‘ঢাকাপ্রকাশ।’ সেই সঙ্গে সহবাসে মেয়েদের সম্মতি চাই, এ ধারণারও বিরোধিতা করেছিল। দাবি তুলেছিল, ‘হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা হিন্দুশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও মুসলমান মৌলবিগণ করবে, আচারভ্রষ্ট, হিন্দুত্বশূন্য বিলাতি সভ্যতা মার্জিত ইব্রাহিমের দল তোমরা কে হে?’
কলকাতার রাজপথ দাপিয়ে ‘শরিয়তে মোহাম্মদি’তে আপস না করার অঙ্গীকার যাঁরা করলেন, তাঁদের কথার সঙ্গে ফারাক আছে?
এ দেশে মুসলমান সমাজে প্রচলিত ‘তিন তালাক’ সমাজে মেয়েদের সমানাধিকারের প্রশ্নটিকে গোড়াতেই নস্যাৎ করে। এক জন ব্যক্তির সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হবে, অথচ তাঁরই মতামতের প্রয়োজন নেই। তাই তিন তালাকের বিরোধিতা করতে শাস্ত্র খোঁজার দরকার পড়ে না। আমরা বলতেই পারি, শাস্ত্র-ধর্ম মানি বা না মানি, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই তিন তালাক প্রথা চলতে পারে না। এখনই তা বাতিল করা উচিত।
তবু শাস্ত্রের যুক্তি জানতে চান অনেকে। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ চালু করতে ‘পরাশর সংহিতা’-কে হাতিয়ার করেছিলেন। আজও মুসলিম সমাজের একটা অংশের কাছে পৌঁছতে গেলে শাস্ত্রবিচার করা দরকার হয়। কিন্তু ইসলামে এক নিঃশ্বাসে পর পর তিন বার ‘তালাক’ বলে বিচ্ছেদ হয় না। বিয়ে সুখের না হলে নির্দিষ্ট নিয়ম ও পদ্ধতির মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই বিচ্ছেদের সুযোগ দিয়েছে ইসলাম। কোরান এ-ও বলছে, ইসলামে তালাক বৈধ হলেও একে ঘৃণার চোখেই দেখেন আল্লাহ্। এক তরফা ভাবে তালাক দেওয়ার যে প্রথা ভারতে প্রচলিত, তাকে প্রশ্রয় দেয় না কোরান। বরং ইসলামে তালাকের যে অর্থ, অর্থাৎ দু’পক্ষের সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ, তা থেকে ইঙ্গিত মেলে যে বিয়েকে একটা চুক্তি হিসেবে দেখা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাস বলে, দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের পর থেকে ধীরে ধীরে সমানাধিকারের ভাবনা থেকে সরে যেতে থাকে ইসলাম। ‘তালাক’ পুরুষতন্ত্রের অস্ত্র হয়ে ওঠে। মহিলাদের ইচ্ছা ও অধিকার পরাহত হয়।
তিন তালাক যে অন্যায়, তা স্বীকার করে তালাকের পদ্ধতি সংস্কার করেছে মিশর (১৯২৯), সুদান (১৯৩৫), জর্ডন (১৯৫১), সিরিয়া (১৯৫৩), মরক্কো (১৯৫৮), ইরান (১৯৫৯), পাকিস্তান (১৯৬১) এবং কুয়েত (১৯৮৪)। বিয়ের মতো বিচ্ছেদকেও রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থার অধীনে এনেছে। তার মানে এই নয় যে, ও সব দেশে পুরুষতন্ত্র নেই। তা সত্ত্বেও চলতি প্রথার থেকে ইসলামিক শাস্ত্রে বিচ্ছেদের তাত্ত্বিক বা ভাবনাগত দিককে ওই রাষ্ট্রগুলি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ আমরা এখনও ‘আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে থাকবেন কি না, তা আমিই ঠিক করব’ বলে মঞ্চ কাঁপাচ্ছি।
প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই মেয়েদের অধিকারের পক্ষে কথা রয়েছে, বিপক্ষেও। সময়ের প্রেক্ষিতে তা বিচার করতে হবে। হিন্দু বা খ্রিস্টান মেয়েরা যে সুরক্ষা পায়, মুসলিম মেয়েরা তা পাবে না কেন? আমরা কেন আইন সংস্কার করব না? বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হব কেন?
পারিবারিক আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে এ রাজ্যে অতীতে বামপন্থীরা ব্যর্থ। তৃণমূল নেতৃত্বও বিপুল ক্ষমতাকে কাজে লাগালেন না। মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড-এর দশা তথৈবচ। কিন্তু শিক্ষিত মুসলমান যুব সম্প্রদায়ই বা কোথায়? এখনও অবধি ফেসবুকের স্টেটাসে কড়া মন্তব্য ছাড়া তাঁদের দেখা মেলেনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে কর্মরত মুসলিম যুবকরা অনেকেই মুসলিম সমাজের রীতিনীতি সম্পর্কে আগ্রহ দেখাই না। ফলে যে ‘নবজাগরণ’ হিন্দু সমাজে ধাক্কা দিল, তার প্রায় আঁচই লাগল না মুসলিম সমাজে। পৃথক ‘ইসলামিক’ পরিচিতি নিয়েই তারা সন্তুষ্ট রইল।
প্রায় ৮৫ বছর আগেই নিজের শেষ (অসমাপ্ত) লেখায় বেগম রোকেয়ার উপলব্ধি ছিল, “আমাদের ধর্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুন, বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় এক তরফা— অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা?’’ ক্ষোভের এই বুদবুদটাকে ঢেউয়ে বদলাতে পারিনি আমরা। আজ তিন তালাকের বিরুদ্ধে শিক্ষিত মুসলিম সমাজকে দাঁড়াতে হবে। দু’দিকের যুক্তিকে হাতিয়ার করে লড়তে হবে। আসল লড়াই, দেশের একটা বড় অংশের মুসলিম মানসের সঙ্গে শিক্ষিত মুসলিম যুবসমাজের বিচ্ছেদ মোছার লড়াই।
সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy