Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

তিন তালাক নিয়ে বুদ্ধির অঙ্ক কষেছেন প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৃহস্পতি এখন যথার্থই তুঙ্গে। বিরোধী দলগুলির পঙ্গুত্ব বা ২০১৮ নির্বাচনের ধরনে চমকপ্রদ প্রচার— যে কারণেই হোক, মা গঙ্গার আঁচল ধরে তাঁর বিজেপি চুটিয়ে জিতল উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশে।

জনাদেশ: ‘বোরখা ও পর্দার অন্তরালে ভারতের মুসলমান নারীসমাজে বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড়।’ বিধানসভা নির্বাচন, ইলাহাবাদ। এএফপি

জনাদেশ: ‘বোরখা ও পর্দার অন্তরালে ভারতের মুসলমান নারীসমাজে বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড়।’ বিধানসভা নির্বাচন, ইলাহাবাদ। এএফপি

সুমিত মিত্র
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৃহস্পতি এখন যথার্থই তুঙ্গে। বিরোধী দলগুলির পঙ্গুত্ব বা ২০১৮ নির্বাচনের ধরনে চমকপ্রদ প্রচার— যে কারণেই হোক, মা গঙ্গার আঁচল ধরে তাঁর বিজেপি চুটিয়ে জিতল উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশে। জিস দেসমে গঙ্গা বহতি হ্যায়, তার ৬০ শতাংশের আকাশে এখন উড়ছে গৈরিক পতাকা।

এ ছাড়াও মোদীর কপাল খুলছে আচম্বিতে, অন্য এক ফ্রন্টে। তা হল বিজেপির সঙ্গে মুসলমান সমাজের সম্পর্ক। দলের উপরতলায় কয়েক জন নাম-কা-ওয়াস্তে মুসলমান রইলেও ‘ভারতীয়’ জনতা পার্টি প্রকৃতপক্ষে ভারতের ১৫ শতাংশ মুসলমানকে জন্মাবধি বর্জন করেছে। এবং মুসলমানরাও বিজেপিকে দেখে শত্রু হিসাবেই। যে সব রাজ্যে অধিক সংখ্যায় মুসলমানের বাস, সেখানে বিজেপির নির্বাচনী মন্ত্র হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভোট-বিভাজন। ভোট এগিয়ে এলেই মুসলমান মহল্লায় মাতব্বরেরা ফিসফিস করে ঠিক করেন, কোন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা সর্বাধিক। ঘরে ঘরে বার্তা পৌঁছে যায়, যেন ভোটটি তার বোতামেই পড়ে, কারণ তা হলে সম্প্রদায়ের একটি ভোটও ‘নষ্ট’ হবে না।

উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে কিন্তু ঘটেছে এক অবাক কাণ্ড। মধ্য উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদ এবং পশ্চিমের বরেলি ও মুজফ্ফরনগর মুসলমান অধ্যুষিত। এ সব অঞ্চলের অনেক আসনে বিজেপি কেবল জেতেনি, আশাতীত ভাবে জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছে। আরও তাজ্জব ব্যাপার ঘটেছে সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ কেন্দ্রে। সিপাহি বিদ্রোহের পরে মুসলমান সমাজ যখন নতুন করে উঠে দাঁড়াতে প্রয়াসী হয়, তখন এই দেওবন্দেই ইসলামি পণ্ডিত শাহ ওয়ালুল্লা দেহলভি গড়ে তোলেন দারুল উলুম দেওবন্দ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি সুন্নি মুসলমানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য। সাহারানপুরে মুসলমান জনসংখ্যা ৬৫ শতাংশ। ১৯৫২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বিধানসভা নির্বাচনে কখনও কোনও হিন্দুত্ব-ঘেঁষা রাজনৈতিক দল দেওবন্দ থেকে জয়ী হয়নি। এ বার অবাক করে দেওয়া ফল— জয়ী বিজেপি, ১০২,২৪৪। ও দিকে সেকুলার ভোট চৌচির হয়ে গেছে এই অনুপাতে: বহুজন সমাজ পার্টি ৭২,৮৪৪, সমাজবাদী পার্টি ৫৫,৩৮৫। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, এই প্রথম মুসলমান গৃহস্থালিতে বড় আকারে দেখা দিয়েছে ভাঙন। তার একটা কারণ, ‘হিন্দুত্ববাদী’ দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে সপা নেতৃত্ব ও পুলিশের আঁতাঁত। অন্য কারণটি অবশ্য আরও গভীর ও ব্যক্তিগত।

সেই কারণটি হচ্ছে বোরখা ও পর্দার অন্তরালে ভারতের মুসলমান নারীসমাজে বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড়। এক নিঃশ্বাসে তিন বার ‘তালাক’ বলে বিবাহিতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার ব্যক্তিগত আইন দ্বারা স্বীকৃত প্রথাটির বিরোধিতা অনেক দিন ধরেই মুসলিম অন্তঃপুরে জন্ম দিয়েছিল প্রতিবাদের চোরা স্রোতের। এই ‘তিন তালাক’ পদ্ধতিটি বহু প্রাচীন। এ ক্ষেত্রে ইসলামের প্রকৃত নির্দেশ কী তা বলা শক্ত, কিন্তু ইসলামের আদিযুগ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে যে শরিয়তি ব্যাখ্যা অনুসরণ করা হয়েছে তা মোটামুটি এই রকম: স্বামী বিবাহবিচ্ছেদ চাইলে সে ‘তালাক’ ঘোষণা করতে পারে তবে তার পর তিন মাস (তিন বার ঋতু) স্ত্রীকে স্পর্শ করা চলবে না। স্বামী যদি বিচ্ছেদে অনড় থাকে তবে সে আবার বলুক ‘তালাক’ এবং আবার তিন মাস সংস্পর্শবিরহিত। তাতেও যদি স্বামীর সিদ্ধান্ত অটল থাকে তবে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পূর্ণ। তবে, সম্ভবত ইসলামের আদিযুগ থেকেই চালু হয় একসঙ্গে তিন বার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে বিবাহবিচ্ছেদের এক করুণ ও নিষ্ঠুর শর্টকাট। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, এক নিঃশ্বাসে তিন বার ‘তালাক’ উচ্চারণ করলে তার আনুশাসনিক গ্রহণযোগ্যতা যে এক বার ‘তালাক’ বলার সমান, তিন বারের নয়, এই রায়টি প্রথম দেন হানবালি ধারার পণ্ডিত ইব্ন তাইমিয়াহ্ (১২৬৩-১৩২৮)। কিন্তু এটি আইন হিসাবে গৃহীত হতে কেটে যায় একটি বা দুটি নয়, সাত-সাতটি শতাব্দী। ১৯২৯ সালে মিশর আইন প্রণয়ন করে যে পর পর তিন বার তিনটি ঋতুমুক্ত সময়ে তালাক দিলে তবেই তা আইনসিদ্ধ। সুদানেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হয় ১৯৪৫ সালে। বর্তমানে ২২টি মুসলমান-প্রধান দেশ মেনে নিয়েছে তাইমিয়াহ্-র বিধান। ইরাক, জর্ডন, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, এমনকী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ।

ভারতবর্ষে মুসলমান মহিলারা বহু কাল যাবৎ প্রার্থনা করছেন, তাঁদের জীবন থেকে দূর হোক তিন-তালাকের অভিশাপ। কিন্তু ‘মুসলমান ভোট’ নামক অ-চর্চিত কিন্তু ভীতিপ্রদ বিষয়টির কারণে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা মুসলমান ব্যক্তিগত আইন সংক্রান্ত আইনের ছায়া পর্যন্ত মাড়ান না। ১৯৮৫ সালে শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়ের পরে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী ভয়ের চোটে সংসদে পাশ করিয়ে নিলেন মুসলিম মহিলা আইন, যা আপাতদৃষ্টিতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ খারিজ করে। আসলে কিন্তু সেই আইনের মধ্যেই রয়ে গেল একটি ধারা যার ফলে মুসলমান বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলার প্রাপ্য আজীবন ভরণপোষণ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুরু থেকেই বুঝেছিলেন তাঁর দলটি যদি মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরে এই অসন্তোষের সাহায্য নিতে পারে তবে হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য। বিজেপি-র অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সুকৌশলে গড়ে তুলেছে মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ। অন্য দিকে শুধু ‘তিন তালাক’ ও ‘নিকাহ্ হালালা’-র (বিবাহবিচ্ছেদের পর একই স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহের জন্য প্রয়োজন এক দ্বিতীয় স্বামী ও তার সঙ্গেও বিবাহবিচ্ছেদ) বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহ করে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের পুরুষতান্ত্রিকতার দিকে এক কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ নামক প্রতিষ্ঠানটি। পুরু পরদায় ঢাকা অন্তঃপুরের অন্দরমহল থেকে মর্মান্তিক সব কাহিনি নথিবদ্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ২৫০ পাতার প্রতিবেদনে। মঞ্চের তিন তালাক বিরোধী আন্দোলনে জমা হয়েছে দশ লক্ষ মুসলমান মহিলার স্বাক্ষর। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে বক্তব্য জানাতে আদেশ দিয়েছেন শীর্ষ আদালত। ৩০ মার্চের আগে। গ্রীষ্মের ছুটিতে টানা সওয়াল জবাব চলবে তিন তালাক মামলার উপর। পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের বিচার্য সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রতি নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে তার ধর্মবিশ্বাস ঘোষণা, চর্চা বা প্রচার করার, সেই অধিকারকে লঙ্ঘন না করে কি ‘তিন তালাক’ প্রভৃতি অযৌক্তিক ও ক্ষতিকর রীতি সংশোধন করা সম্ভব?

পরিশেষে বলা প্রয়োজন, সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতে মুসলমান বিবাহ যে হিন্দু বিবাহের চেয়ে খুব একটা বেশি বিচ্ছেদপ্রবণ, তা ঠিক নয়। বোঝা যায়, মুসলমান নারী সমাজ আসলে যে কারণে উত্ত্যক্ত, তা হল আইনের এক সুবৃহৎ ফাঁক, যা কাজে লাগিয়ে পতিদেবতা সর্বদা তাঁদের তটস্থ রাখতে পারেন। আর এই সুযোগটিকে মোক্ষম ভাবে কাজে লাগিয়ে মোদী প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে, তিনি যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথকে উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর ত‌খ‌্‌তে বসাতে পারেন, তেমনই মুসলমান নারীহৃদয়ে তাঁর অবাধ প্রবেশাধিকার। তিনি ধর্মে আছেন, জিরাফেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE