আর ক’দিন পরেই নজীব অহমদ নিখোঁজ হওয়ার মেয়াদ দু’ মাস হবে। মেয়াদ আরও বাড়বে যদি পুলিশ এ রকমই নিস্পৃহ নিষ্ক্রিয় থাকে। জেএনইউ-তে পাঠরত উত্তরপ্রদেশের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেধাবী এই ছাত্রটির বেমালুম উধাও হওয়ায় কিচ্ছু আসে যায় না দিল্লি পুলিশের, বরং তারা তৎপর বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের সঙ্গে নজীবের মা-বোনকেও টেনে-হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাওয়ায়। রাষ্ট্র-আনুগত্যের এটাই তো দস্তুর।
ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি ছাত্র সংগঠনের বাহুবল আছে নজীবের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে, এ আশঙ্কা বা অভিযোগ এখন জনসমক্ষে এসে গিয়েছে, কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল— ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ আমাদের সরকার, বা তার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। আর এই নিষ্ক্রিয় নিস্পৃহ মনোভাব যে সংখ্যাগরিষ্ঠের একটা বড় অংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই, সে কথা বোধ হয় স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে। প্রায় প্রতি দিন নাবালিকা থেকে সাবালিকাদের গণধর্ষণের ঘটনা এবং খুন এমনই আর এক হাতেনগদ প্রমাণ। কখনও আবার জেল-ছুট নিরস্ত্র কয়েদিদের শরীর গুলি চালিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করার পর পুলিশকে সরাসরি সমর্থন করেন কোনও মুখ্যমন্ত্রী। অপরাধী বা নিরপরাধ, পুরুষ কিংবা নারী, ব্যক্তি হিসেবে কারও যেন শান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকার কোনও অধিকার নেই, স্বাভাবিক জীবন যাপনের কোনও গ্যারান্টি নেই। অথচ আমাদের দেশের কাঠামোটি গণতান্ত্রিক।
গণতন্ত্রের এই চেহারাছবি নিয়েই সপ্রশ্ন আদুর গোপালকৃষ্ণন। গণতন্ত্রের নানাবিধ সুফল পেয়েছেন তিনি, তাই এ দেশের গণতন্ত্রের ওপর আস্থা নেই, এমনটা বলেন না কখনও। কিন্তু বারে বারে তাঁর ছবির ভিতর দিয়ে খেয়াল করাতেও ভোলেন না, গণতান্ত্রিক যে কাঠামোতে আমাদের দৈনন্দিন বসবাস, সেটি মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র।
ফলত সমাজ বা সংসারে সমবেত বসবাসের মধ্যে অনেক সময়ই আমরা ব্যক্তির ওপর সমষ্টির মত চাপিয়ে দিই, ইচ্ছে-অনিচ্ছে নিরপেক্ষ ভাবেই তাঁর ওপর অবিচার করে বসি, নিজেরা সেটা বুঝতেও পারি না। বিপদ আরও বাড়ে, যখন ব্যক্তির ঘাড়ে সমষ্টির প্রতিভূ হিসেবে আরও নানা প্রাতিষ্ঠানিকতা চেপে বসে। পরিবার থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজশক্তি— আইন-আদালত-পুলিশ-প্রশাসন, কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠী— সব সময়ই ব্যক্তির স্বাধীন বাঁচার চেষ্টাকে রুদ্ধ করে, সন্ত্রস্ত করে। এই সমস্ত বাধ্যতা, পেষণ, শাসন রুখে দিতে চায় আদুরের ছবির চরিত্রেরা। তাদের বেঁচে থাকার সেই আবেগকেই প্রতি ছবিতে প্রতিপাদ্য করে তোলেন তিনি, নিজের প্রতিস্পর্ধী চলনে।
বিপুল জনসংখ্যার দেশ আমাদের, গর্ব করার মতো গণতন্ত্র। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠকে অমান্য করার মতো স্পর্ধাই শুধু দেখান না আদুর, উপরন্তু তাঁর ছবিতে উঠে আসা মানুষগুলিকে একা থাকার, একা বাঁচার, একলা লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখান, যত অধরা যত ভঙ্গুর যত অবাস্তবই হোক সে স্বপ্ন, তবু। পরিচালক হিসেবে তিনি যেন পর্যবেক্ষকের মতো দেখতে থাকেন এবং আমাদেরও দেখাতে থাকেন, কতটা অন্তহীন অপেক্ষা এরা করতে পারে, অসহ্য দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও কতটা আশায় এরা দিন গুনতে পারে, নিজেদের একার লড়াইটা কত দূর অবধি এরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্বয়ম্বরম, এলিপ্পাত্থয়ম, মুখামুখম, অনন্তরম, মাথিলুকাল, বিধেয়ন, কথাপুরুষণ, নিঝালকুথু, ফোর উইমেন, আ ক্লাইমেট ফর ক্রাইম— প্রতিটি ছবিই যেন ব্যক্তির আত্মপরিচয় পাওয়ার প্রস্তুতি। সে প্রস্তুতির বিনাশ হয়তো অনেক সময় অঙ্কুরেই, দীর্ঘ কারাবাসে, কিংবা কোনও রাজশক্তি বা প্রভুত্বের সেবায়। কিন্তু তাতেও ব্যক্তিটি সরে না তার মানসিক প্রস্তুতি থেকে।
দেশ জুড়ে নিরন্তর নানা নির্বাচনে বাম-ডান দুই রাজনৈতিক পক্ষই, সংসদীয় গণতন্ত্রে জনসাধারণের মন পাওয়ার জন্য লড়াই করেন যাঁরা, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন যাঁরা, সংখ্যালঘু বা প্রান্তিকদের ত্রাতা হয়ে ওঠেন যাঁরা, তাঁদের কিন্তু ভারী অপছন্দ আত্মপরিচয়ের খোঁজে এই একলা মানুষের লড়াই। ধ্বজা উড়িয়ে সমবেত লড়াইয়ের কথাই তো উচ্চরবে হাঁকেন তাঁরা, তাঁদের কাছে সমষ্টিই শক্তি, ব্যক্তির ভিতর আবার শক্তি কোথায়?
অথচ সমাজ-সভ্যতা নিরপেক্ষ ভাবেই ব্যক্তির একটা দায় থাকে ব্যক্তি হয়ে ওঠার, সে নিজেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই দায় কাঁধে তুলে নেয়। বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আত্মপ্রতিরোধের ভিতর দিয়ে তার অভিপ্রায়ের দিকে এগিয়ে চলে। ভুল হোক, ঠিক হোক, যত তুচ্ছ বা সামান্যই হোক, ব্যক্তি তার লড়াইটা জারি রাখে।
মুশকিল হল, আমাদের সত্তর-ছুঁইছুঁই স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই তো সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত পরিচয়টাকে একমাত্র আত্মপরিচয় ঠাওরেছি। দীর্ঘ পরাধীনতা আমাদের আত্মপরিচয় অর্জনের প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে ফেলেছে, স্বাধীনতার জন্য সমষ্টির জাগরণ এতটাই বড় হয়ে উঠেছিল যে, ব্যক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা সে ভাবে করিনি আমরা। নাগরিক বলে দাবি করি বটে, নাগরিক মনটাই যে নেই আমাদের, মনে করিয়ে দেন আদুর।
মূলস্রোতের ভারতীয় ছবিতে তারই প্রতিফলন। ব্যক্তির ভিতর যে রহস্যময় মানুষটা বাস করে, তার মনের মধ্যে যে খাড়াই-উৎরাই লড়াই, তা কখনওই ধরা পড়ে না আমাদের ছবিতে। যে ব্যক্তিকে নিয়ত আমরা দেখি ফিল্মে, সে কোনও না কোনও সামাজিক বর্গের সঙ্গে, কমবেশি কোনও সমবেত লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে, সমাজের মানুষজনের একটা গড় চেহারা ফুটে ওঠে তার মধ্যে। এই গড় চেহারার মানুষটির জীবনে কোনও ব্যক্তিগত সংকট বা বিপর্যয়ই তাকে আদপে ততটা ব্যক্তিগত ভাবে বিপন্ন করে না, যাতে বেদনায়-বিষাদে সে এক জন স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে ওঠে।
আদুর তাঁর ছবিতে সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রসঙ্গ তোলেন প্রবল ভাবে, বলেন যে তাঁর ছবি হল ‘মানুষের মনকে, তার সমস্ত জটিলতা সহ, বুঝতে আমার চেষ্টা’। তাঁর ছবির মানুষটা নিজের ব্যক্তিগত পরিসরকে সকলের সামনে মেলে ধরতে নারাজ, ব্যক্তিগত ভাবে বাঁচতে চায় সে, নিজের লড়াইটা নিজেই লড়তে চায়। আমরা বিপন্ন বোধ করলেই চট করে সমষ্টিতে লগ্ন হতে চাই, চেনা বৃত্তের খোঁজ করতে থাকি, আমাদের বেঁচে থাকার সমাজ-মুখাপেক্ষী এই ধরনধারণ, রীতিনীতি নিয়েই প্রশ্ন তোলেন আদুর। অতএব তাঁর ছবিকে কতটুকু সইতে পারবে মূলস্রোতের বাজার? দেশটা তো সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের।
তবে, বাঁচার এই যে ব্যক্তিগত ধরন, সম্পর্কের এই অনির্দিষ্ট রকম, তার প্রণেতা হয়ে উঠেছেন বলেই নতুন ভাবে আমাদের ভাবাতে পারছেন আদুর। এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর নতুন ছবি ‘পিন্নেইয়াম’ (উপরে তারই একটি দৃশ্য) বা ‘ওয়ানস আগেন’-এর প্রদর্শনী সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রচলিত নৈতিকতার বাইরে ব্যক্তির সমাজ-অস্বীকৃত বেঁচে থাকার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে দিল।
সমাজকর্তারা মানুন বা না মানুন, কিচ্ছু আসে যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy